রহীমের দুঃসহ জীবন, আকবরের পুত্র দানিয়ালের মৃত্যু হয় ১৬০৪ খ্রিস্টাব্দে, আকবরের শাসনের শেষ সময়ে । দানিয়াল রহীমের জামাতা ছিলেন। ঊনপঞ্চাশ বছর বয়সে পৌছতে পৌঁছতে রহীমকে পুত্র ও জামাতা বিয়োগের শোকতাপ সহ্য করতে হয়। রহীমের বয়স যখন পঞ্চাশ বছর, তখন জাহাঙ্গির সিংহাসনে আরোহণ করেন ।
রহীমের দুঃসহ জীবন | রহীম | আকবর
তখনও রহীম দক্ষিণের সেনাপতি ছিলেন। তেপ্পান্ন বছর বয়সে (১৬০৮ খ্রিঃ) বৃদ্ধ সেনাপতিকে প্রথম পরাজয় স্বীকার করতে হয় আহমদনগরে। ছাপ্পান্ন বছর বয়সে (১৬১১ খ্রিঃ) তিনি কনৌজ কালপী জায়গির পান। ভেবেছিলেন, বাকি জীবন শান্তিতে কাটাবেন।
পরের বছরেই মসনদের উত্তরাধিকারী শাহজাহানের সঙ্গে তার পৌত্রী ও শাহনওয়াজের কন্যার বিবাহ ছিল অত্যন্ত আনন্দের বিষয়। পরের বছর রহীমের জ্যেষ্ঠ পুত্র এরাজের মৃত্যু হয়, তার পরের বছরেই দ্বিতীয় পুত্র রহমান দাদও জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার অনুগমন করে। নিজের পুত্রদের মৃত্যু দেখার জন্যই যেন দীর্ঘকাল বেঁচে ছিলেন রহীম। পিতা-পিতামহের মতোই জাহাঙ্গির চাইতেন তাঁর সাম্রাজ্যকে কাবুল-কন্দাহার
থেকে আরও বিস্তৃত করতে, সেজন্য কন্দাহার ইতিপূর্বে পুনরায় হস্তচ্যুত হওয়াটা তাঁর মনঃপূত ছিল না। ১৬২১ খ্রিস্টাব্দে জাহাঙ্গির মনস্থ করলেন, শাহজাহানকে সঙ্গে নিয়ে বৃদ্ধ সেনাপতি কন্দাহার পুনরুদ্ধারে যান। যদি তিনি সেই যুদ্ধাভিযানে যেতেন, তাহলে তাঁর জীবনের অন্তিম বছরটি অন্যদের মতোই হতো।
এরই মধ্যে শাহজাহান ও তাঁর ভ্রাতা শাহরিয়ারের মধ্যে কলহ সৃষ্টি হয়। শাহরিয়ার নূরজাহানের প্রথম পক্ষের কন্যাকে বিবাহ করেছিলেন, সেহেতু শাহরিয়ার ছিলেন নূরজাহানের জামাতা এবং শাহজাহান ছিলেন তাঁর সৎপুত্র। জাহাঙ্গির শাহজাহানকে বেশি ভালোবাসতেন, কিন্তু নূরজাহানের সামনে তাঁর মুখে কথা যোগাত না।
নূরজাহানের কথামতো শাহরিয়ারকে ধওলপুর জায়গির দেওয়া হয়। কিন্তু ভুলবশতঃ সেই জায়গির পেয়ে যান শাহজাহান। উভয়ের লোকজনের মধ্যে রক্তারক্তি কাণ্ড বেধে যায়। শাহজাহান রহীমের নাতজামাই ছিলেন, সেজন্য এই বিষয় নিয়ে জাহাঙ্গিরের সঙ্গে বৃদ্ধ আতালীকের মনোমালিন্য হয়। মনোমালিন্য আবার ভীষণ শত্রুতার পর্যবসিত হয়।
জাহাঙ্গির রহীমের পুত্র দারাবের মাথা কেটে রহীমের নিকট উপঢৌকন হিসেবে পাঠিয়ে দিলেন। বলতে বললেন— বাদশাহ আপনার জন্য খরবুজা উপহার পাঠিয়েছেন। সত্তর বছরের বৃদ্ধ রুমাল সরিয়ে দেখতে পেলেন তাঁর পুত্রের কাটা মাথা। কোনো ব্যক্তির উপর-চরমতম ক্লেশ ও নিপীড়ন কি হতে পারে, রহীম তা দেখেছিলেন। পরে বাদশাহ যতই অনুতাপ করুন না কেন, তাতে কি যায় আসে? পিতা-পুত্রের সম্পর্ক যাতে নষ্ট না হয়, রহীম তার চেষ্টা করেছিলেন এবং তার ফল হল বিপরীত।
পুত্র শাহজাহানকে কয়েদখানায় কাটাতে হয়েছিল, এবং জাহাঙ্গির তাঁর সর্বস্ব হরণ করে, তাঁর পুত্রের ওই রূপ দৃশ্য দেখিয়েছিলেন রহীমকে। তারপর তিনি আর বেশিদিন বাঁচেননি। সেই বছরই বাদশাহ তাঁর হৃদয়-ক্ষত উপশমের চেষ্টা করেছিলেন। পুনরায় তাঁকে ‘খানখানা’ উপাধি দিয়েছিলেন, জায়গির ও পূর্বের মতোই সম্মানজনক পদ প্রদান করেছিলেন।

কিন্তু, তাতে কি যায় আসে? ১৬২৭ খ্রিস্টাব্দের ১লা ফেব্রুয়ারি দিল্লীতে তাঁর প্রাণবিয়োগ হয়। হুমায়ূনের সমাধিসৌধের অনতিদূরে রহীমেরও জমকালো সমাধিসৌধ নির্মিত হয় লাল মর্মরে। অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে সফদরজঙ্গ সেই মর্মর পাথর খসিয়ে এনে নিজের নামের অট্টালিকায় ব্যবহার করেন। দিল্লী রহীমকে ভুলে গেছে। একসময় তো মনে হয়েছিল তাঁর সমাধিসৌধটিও তাঁর নামের মতোই একদিন বিলীন হয়ে যাবে ।
আরও দেখুনঃ