শ্রেষ্ঠ সেনাপতি মানসিংহ | মানসিংহ | আকবর

শ্রেষ্ঠ সেনাপতি মানসিংহ

 শ্রেষ্ঠ সেনাপতি মানসিংহ | মানসিংহ | আকবর

 

 শ্রেষ্ঠ সেনাপতি মানসিংহ | মানসিংহ | আকবর

 

১. গুজরাত-বিজয়— ১৫৭২ খ্রিস্টাব্দের ৪ঠা জুলাই গুজরাত-বিজয়ের জন্য আকবর ফতেহপুর-সিক্রী যাত্রা করেন। গুজরাতের রাজধানী আহমদাবাদের সন্নিকটে পৌঁছান নভেম্বরে। গুজরাতী তখতের দাবিদার মুজফ্ফরশাহকে সহজেই ধরে এনে তাঁকে পেশন দিয়ে নিজের অধীন করেন আকবর, কিন্তু তাতেই কার্যোদ্ধার হওয়া সম্ভব ছিল না। আকবরের নিজের তৈমূর-বংশের মির্জা, বাবরের কৃপাপাত্র, বিরুদ্ধতা করছিলেন। ইব্রাহিম হুসেন মির্জা সম্ভল থেকে গিয়ে গুজরাতের ভূস্বামী হতে চেয়েছিলেন।

তিনি ছোট শহর সরনালে আছেন খবর পেয়ে আকবর মাহী নদীর তীরে উপস্থিত হন । শত্রুর ক্ষমতার কথা জেনেও অন্যদের পরামর্শ না মেনে মাত্র দুই শত লোক নিয়ে আকবর আক্রমণ করতে মনস্থ করেন। এই দুই শত জন লোকের মধ্যে মানসিংহ ও ভগবানদাসও ছিলেন।

অত্যন্ত বিপজ্জনক পদক্ষেপ। সরনালের গলিপথে আকবর ও তাঁর দুই শত লোক সর্বস্ব পণ করে দিনমানেই ঢুকে পড়েন। যুদ্ধে রাজা ভগবানদাসের ভ্রাতা ভূপতি নিহত হন। ভগবানদাস বাদশাহের প্রাণরক্ষার জন্য অত্যন্ত সাহসিকতা প্রদর্শন করেছিলেন।

একবার তিনজন বাদশাহের একেবারে কাছে এসে পৌঁছে গিয়েছিল। সে-সময় ভগবানদাস একজনকে বর্শাবিদ্ধ করে ভূপাতিত করেন। বাকি দু’জনকে প্রতিরোধ করেন আকবর। জয়লাভ আকবরের হস্তগত হয়। ২৪শে ডিসেম্বর বীরদের সম্মান প্রদর্শন করা হয়। রাজা ভগবানদাস পতাকা ও নাকাড়া পুরস্কার লাভ করেন। পূর্বে কোনো হিন্দু এই সম্মানে ভূষিত হননি ।

১৫৭৩ খ্রিস্টাব্দের ২৩শে আগস্ট আকবর ফতেহপুর-সিক্রী থেকে গুজরাতের উদ্দেশে রওনা হত। আজমের, জালৌর, দীসা পাটন হয়ে প্রতিদিন পঞ্চাশ মাইল হিসেবে ছয় শত মাইল পথ অতিক্রম করে আহমদাবাদে পৌছান। এই যাত্রাতেও রাজ ভগবানদাস ও কুমার মানসিংহ তাঁর সঙ্গে ছিলেন ।

আকবর ১৫৭৩ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে ফেব্রুয়ারি সুরাত অধিকার করেন। এই সময়ের একটি ঘটনা : শাহী সুরাপানের আসর বসেছিল। যদিও আকবর তাঁর পুত্রদের মতো ভয়ঙ্কর সুরাপায়ী ছিলেন না, তথাপি নিজের সঙ্গী-সাথীদের থেকে পিছিয়ে থাকতেও বর্শা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, দুই দিক থেকে দু’জন রাজপুত দৌড়ে এসে বুকে দিয়ে সেই বর্শাফলকে এমন জোরে ধাক্কা মারল যে বর্শা-ফলক তাদের বুক ভেদ করে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে গেল।

হ্যা, এরকম পাল্লা দেওয়ার লোক থাকতে পারে, কিন্তু সেখানে প্রতিদ্বন্দ্বী হবে কে? তিনি স্বয়ং এই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অংশগ্রহণের কথা ঘোষণা করলেন। তরোয়ালের বাট দেয়ালে আটকে দূর থেকে তিনি দৌড়ে গেলেন বুক দিয়ে আকবরের সেই তরোয়ালের ডগায় ধাক্কা মারতে। এমন সময় মানসিংহ এক ঝটকায় তরোয়াটিকে মাটিতে ফেলে দেন। সেটা করতে গিয়ে আকবরের হাতে তরোয়ালের চোট লাগে। তিনি তৎক্ষণাৎ মানসিংহকে ভূপাতিত করে দু’হাতে তাঁর গলা চেপে ধরেন। এরকম অবস্থা দেখে সৈয়দ মুজফ্ফর আকবরের আঙুল মুচড়ে মানসিংহের গলা ছাড়ান। নেশার ঝোঁকে আকবর কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন, তাতে সন্দেহ নেই ।

২. হলদি ঘাটী (জুন, ১৫৭৬)— চিতৌড়ের পতনের সময় আকবরকে উদয়সিংহের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হতে হয়েছিল। উদয়সিংহ মোকাবিলা করতে সক্ষম হননি, কিন্তু তাঁর পুত্র প্রতাপ স্বাধীনতার পতাকা হাতে তুলে নেন। তিনি মাথায় শবাচ্ছাদন বেধে মোগল সেনাকে নাজেহাল করে তুলছিলেন।

ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথের বক্তব্য অনুসারে— “তার জাতিপ্রেমই তাঁর অপরাধ ছিল। আকবর অধিকাংশ রাজপুত রাজাকেই আলাপ-আলোচনায় এবং রাজনৈতিক কৌশলে নিজের বশীভূত করেছিলেন। তিনি রানা প্রতাপের স্বাধীনতা-প্রিয়তা বরদাস্ত করতে পারেননি। যদি তিনি মাথা নত না করেন, তাহলে তাঁকে বিনাশ করতে হবে।” প্রতাপকে জব্দ করার জন্য যে সেনা পাঠানো হয়, নামে তার প্রধান সেনাপতি শাহজাদা সলীম ছিলেন, কার্যত তারা কুমার মানসিংহের অধীন ছিল।

সাত বছর বয়স্ক সলীম সৈন্য-পরিচালনা কি আর করবেন? রানা যুদ্ধের সম্মুখীন হওয়ার জন্য তিন হাজার অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে হলদিঘাটীতে প্রস্তুত হয়েছিলেন, সেখান থেকে গোগুণ্ডা দুর্গে যাওয়ার পথ। খমনোর গ্রামের কাছে এই উপত্যকাতেই ইতিহাসে স্মরণীয় এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দের জুনে।

এ বিষয়ে টড লিখেছেন— “এই উপত্যকায় মেওয়াড়ের তরুণ পুষ্প প্রস্তুত হয়ে অপেক্ষা করছিলেন এবং তাঁকে রক্ষা করার জন্য যে মহতী সঙ্ঘর্ষ হয়েছিল, তা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।” ঐতিহাসিক বদায়ূনী জেহাদের পুণ্য সঞ্চয়ের জন্য কলমের বদলে তরোয়াল নিয়ে সেখানে এস পৌঁছেছিলেন। কিন্তু বিধর্মী মানসিংহের অধীনে কি করে জেহাদ করা যায়? যুদ্ধ সূর্যোদয় থেকে মধ্যাহ্ন পর্যন্ত চলেছিল।

তার ভয়ঙ্করতার কথা কি আর বলা যায়? মোগল সাম্রাজ্যের সমস্ত শক্তি এক দিকে, অপর দিকে আরাবলীর পাহাড়ে পাহাড়ে আহত-ক্ষতবিক্ষত হয়ে ছুটে বেড়াচ্ছেন রানা ও তাঁর মুষ্টিমেয় বীর। রানা আহত হয়েছিলেন। চেতক নিজের প্রাণবলি দিয়ে রানাকে যুদ্ধক্ষেত্রের বাইরে পৌছে দিয়েছিল। মানসিংহ বদায়ূনীর তত্ত্বাবধানে রানার প্রসিদ্ধ হাতিটিকে সিক্রীতে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু এই পরাজয় এমন নয় যে প্রতাপের মনোবল ভেঙে গিয়েছিল ।

কিছুকাল পরে যখন আকবর অন্যপ্রান্তে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, তখন সেই সুযোগে প্রতাপ ১৫৯৭ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুর আগে চিতৌড় আজমের ও মাঁডলগড় ব্যতীত সমগ্র মেওয়াড় পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হন। ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথ প্রতাপের যুদ্ধ বিষয়ে লিখেছেন— “আকবরর ঐতিহাসিক… যদিও সেই বীর শত্রুদের সম্পর্কে হয়তো কদাচিৎ একটি শব্দ ব্যয় করেছেন, যাদের দুঃখ-বিপদ ও প্রয়াসহীনতা আকবরকে বিজয়ী করেছিল, তথাপি সেই বিজিত নারী-পুরুষও স্মরণীয়, বলতে গেলে, বিজেতাদের অপেক্ষায় অধিকতর।”

 

 শ্রেষ্ঠ সেনাপতি মানসিংহ | মানসিংহ | আকবর

 

আকবর হলদিঘাটীর সাত বছর পূর্বে রণথম্ভৌর অধিকার করেছিলেন। সেই যুদ্ধ শুরু হয়েছিল ১৫৬৯ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারিতে। তাতেও রাজা ভগবানদাস ও কুমার মানসিংহ যুদ্ধ করে বাদশাহের প্রতি তাঁদের ভক্তি ও পরাক্রমের পরিচয় দিয়েছিলেন। ওই বছরই আগস্টে কালিঞ্জর আকবরের হস্তগত হয়। এইভাবে মধ্যপ্রদেশের অজেয় দুর্গ হস্তগত হওয়ার ফলে আকবর সাম্রাজ্যের এই অংশ সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হন। একদিকে তিনি সাফল্য লাভ করেন, অন্যদিকে নতুন বৈরিতা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ৩. কাবুল অভিযান— আকবরের অনুজ (সৎভ্রাতা) মির্জা মুহম্মদ হাকিম কাবুলের কিন্তু (আফগানিস্তান) শাসক ছিলেন।

 বহু প্রাদেশিক শাসনকর্তা বিদ্রোহ করতে গিয়ে জঘন্যভাবে ধ্বংস হন। ইতিমধ্যে আকবর প্রকাশ্যভাবে ইসলামকে অস্বীকার করে বসেন, তার ফলে মোল্লা ও স্বার্থপর আমিরেরা তিক্ত-বিরক্ত হয়ে ভাবেন যে যদি তাঁরা হুমায়ূনের দ্বিতীয় পুত্রকে আকবরের বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে পারেন, তাহলে তাঁদের কার্যসিদ্ধি হতে পারে।

তাঁদের নজর পড়ল হাকিমের উপর। কিন্তু হাকিম “অত্যন্ত নীচ এক প্রাণী। তিনি শাসনকার্যে কিংবা যুদ্ধক্ষেত্রে আপন ভ্রাতার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য একেবারেই অযোগ্য ছিলেন।” শুরুতেই আকবর এই ষড়যন্ত্রের কথা অবগত হন । অর্থমন্ত্রী শাহ মনসুর একজন সামান্য করণিক থেকে এমন উচ্চপদে আরোহণ করেছিলেন নিজের যোগ্যতায়, তার চেয়েও বেশি, আকবরের অনুগ্রহে।

তিনিও এই ষড়যন্ত্রের শরিক ছিলেন। তাঁর লেখা চিঠিপত্র ধরা পড়ে। একমাস পূর্বে তাঁকে পদ থেকে অপসারণ করার পর পুনরায় তাঁকে তাঁর পদে পুনর্বহাল করা হয়, কিন্তু তবুও তাঁর স্বভাবের কোনো পরিবর্তন হয়নি, ফলে তাঁকে কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে মির্জা হাকিমের অমাত্য নূরুদ্দীন পাঞ্জাব আক্রমণ করেন।

পূর্বে এই একই কাজ করতে গিয়ে শাদমানকে প্রাণ হারাতে হয়েছিল। তাঁর আসবাবপত্রের মধ্যে বহু চিঠিপত্র পাওয়া গিয়েছিল যার মাধ্যমে শাহ মনসুর ও বহু উচ্চপদাধিকারীদের স্বরূপ উদঘাটিত হয়। আকবর যদি রাজপুতদের বলে বলীয়ান না হতেন, তাহলে তাঁকে মোল্লা ও জেহাদীদের সাহায্য নিয়েই চলতে হতো, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। রাজপুতদের তরবারি একজোট করতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন মানসিংহ। শেখ-সৈয়দ-মোগল-পাঠানদের উপর আকবর কিভাবে বিশ্বাস স্থাপন করতে পারেন, যদি তারা তাঁরই অনুগ্রহে মন্ত্রিত্বের উচ্চ-উচ্চ পদে পৌঁছানোর পরেও প্রতারণা করতে তৈরি হয়?

আকবর মানসিংহকে শিয়ালকোট জায়গির দিয়েছিলেন। তিনি শিয়ালকোটে ব্যবস্থাপনায় রত হন এবং অমাত্যদের সিন্ধু-তীরে অবস্থিত অটক দুর্গের বন্দোবস্ত করতে পাঠিয়ে দেন। শাদমান, মির্জার কোকা (দুগ্ধভ্রাতা) ছিলেন। তাঁর মাতা মির্জাকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছিলেন। মির্জার সঙ্গে খেলাধূলা করেই তিনি বড় হয়েছিলেন এবং প্রকৃতপক্ষে তিনি সাহসী যুবক ছিলেন। শাদমান অটক দুর্গ অবরোধ করে বসেন। মানসিংহও রাওয়ালপিণ্ডিতে উপস্থিত হন। সংবাদ পাওয়ামাত্র তিনি অটকের উদ্দেশে ধাবিত হন।

শাদমান ও মানসিংহের ভ্রাতা সুরজসিংহ তাঁদের শৌর্য প্রদর্শন করেন। শেষ পর্যন্ত রাজপুতের তরবারিতে তাঁর জীবনলীলা সাঙ্গ হয়। এই খবর পেয়ে মির্জা স্বয়ং আঠারো হাজার অশ্বারোহী সেনা নিয়ে চলে আসেন। আকবর আদেশ পাঠান : পরাজিত করে বিতারিত করা নয়, বরং তাঁকে হস্তগত করা আবশ্যক। বাদশাহী ফৌজ পশ্চাৎপদ হতে থাকলে মির্জার সাহস বেড়ে যায় এবং পশ্চাদ্ধাবন করতে করতে লাহৌরে রাবীর তীরে বাগ-মেহেন্দী কাসিম খাঁ-তে এসে অবতরণ করেন। রাজা ভগবানদাস, কুমার মানসিংহ, সৈয়দ হামিদ বারা ও অন্যান্য শাহী আমিরেরা লাহৌরের মধ্যে দুর্গে ঢুকে পড়েন ।

অবিলম্বে মির্জা বুঝতে পারেন, তাঁকে ফাঁদে ফেলার জন্যই টোপ দেওয়া হয়েছিল । আকবরও সীমান্তে পৌঁছে গিয়েছিলেন। মিজা কাবুলের দিকে পালাতে শুরু করেন। বাগ-মেহেন্দী থেকে এক ক্রোশ উজানে গিয়ে রাবী পার হন। জালালপুর এলাকায় চনাব ও ভেরার কাছে ঝেলমে নামেন।

তারপর পিণ্ডিঘেপের কাছে সিন্ধু পেরিয়ে কাবুলের দিকে পালিয়ে যান। এভাবে কি শিকারকে হাতছাড়া করা যায়? মানসিংহ তাঁর সৈন্যবাহিনী নিয়ে পেশাওয়ার অভিমুখে অগ্রসর হন। সঙ্গে ছিলেন দ্বাদশ বর্ষীয় সলীম ও একাদশ বর্ষীয় মুরাদ দুই শাহজাদা, নিজের নিজের বাহিনীর সেনাপ্রধান তাঁরা, তা যে কেবল শোভাবর্ধনের জন্যই, এ কথা বলা বাহুল্য ।

দুর্গ-নগরী কাবুল আমিরদের (সেনাধ্যক্ষদের) মনঃপূত ছিল না। সেখানকার ঠাণ্ডা ও তার দ্বিগুণ কষ্টভোগের কথা তাঁরা ভালো করেই জানতেন, সেজন্য পেশাওয়ার থেকে আগে যেতে চাইতেন না। তাঁরা নানাভাবে বাদশাহকে বোঝাবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু আকবর তাতে কর্ণপাত করলেন না।

তিনি মানসিংহকে সম্মুখে অগ্রসর হওয়ার আদেশ দিলেন। বর্ষার ভরা-নদী সিন্ধুতে নৌকার সেতু নির্মাণ সম্ভব হল না। পৃথক পৃথক নৌকায় আকবর ও তাঁর সেনা সিন্ধু অতিক্রম করলেন। আকবর মধুর-বচনে মির্জাকে বোঝাবার চেষ্টা করতেন— “তোমার বংশেরই আমির আজ দেশ শাসন করছে।

এই ধন-সম্পদ থেকে ভাই বঞ্চিত থাকবে কেন? প্রবীণ জ্ঞানীব্যক্তিরা ছোট ভাইকে পুত্র-তুল্য বলেছেন। আসল কথা, আরও পুত্র-সন্তানের জন্ম হতে পারে, কিন্তু ভাই আর পাওয়া যায় না। তোমার বুদ্ধি-বিবেচনায় এটা মেনে নেওয়া উচিত যে মোহাচ্ছন্ন না থেকে মিলেমিশে সৌভাগ্য-সুখ লাভ করা ভালো।” এসব কথায় কোনো বাঞ্ছিত ফল দেখা যায়নি, বরং ষড়যন্ত্রের আরও কিছু পত্র ধরা পড়ে। যুদ্ধ-পরিষদের বৈঠক বসে। অনেকেই পরামর্শ দেন, মির্জাকে ক্ষমা করে তাঁকে রাজ্য দান করে ফিরে যাওয়া হোক।

আবুল ফজল তখন ত্রিশ বছরের এক নবযুবক। তি তিনি এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে জানান, শাহী সেনা এত মালপত্র নিয়ে এতদূর এসে পড়েছে। বাদশাহ এখানে স্বয়ং সেনাপতি রয়েছেন, লক্ষ্যও খুব বেশি দূরে নয় । এরকম পরিস্থিতিতে এমন ভোঁতা কথাবার্তায় ফিরে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়।

ফিরতে গেলেও দেখুন— বর্ষা এসে গেছে, নদ-নদীতে বন্যা। আসবাবপত্র-সহ এমন বিশাল বাহিনীর পক্ষে নদী অতিক্রম করা কত কঠিন। পরিষদের অন্যান্য আমিরেরা আবুল ফজলের কথায় অসন্তুষ্ট হলেন। তাতে আবুল ফজল বললেন— ভালো কথা। প্রত্যেকে নিজের নিজের অভিমত পেশ করুন। আমাকে যতক্ষণ না কিছু জিজ্ঞাসা করা হবে, ততক্ষণ আমি কথা বলব না। পরিষদের কার্যবিবরণী লিখে বাদশাহের সম্মুখে উপস্থাপন করা হল । দৈবাৎ আবুল ফজল জ্বলে আক্রান্ত হন, তাই তিনি সভায় উপস্থিত ছিলেন না।

আমিরেরা নানা ফন্দি- ফিকির খাটাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু একটাও ধোপে টিকল না। আকবর বললেন— “কাবুলের ঠান্ডা ও পথযাত্রার কষ্টকে ভয় পেয়ে যারা আরামের কথা ভাবছেন এবং কাজের কথা যাদের মাথায় আসছে না, তারা এখানেই থাকুন। আমি সেনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছি।” তখন সম্মুখে অগ্রসর হওয়া ছাড়া আর উপায় কি? সলীমকে রাজা ভগবানদাসের সঙ্গে পেশাওয়ারে রেখে সৈন্যবাহিনী রওনা দিলো ।

মির্জা হাকিম জানতে পারেন বাদশাহ ও তাঁর সৈন্য-সামন্ত অটকে বিনা সেতুতেই নদী পার হয়ে এসেছেন। তাঁর সাহস ভেঙে পড়ে। নিজের সন্তান-সন্ততিদের বদখশা পাঠিয়ে দিয়ে তিনি নিজেও কাবুল থেকে বেরিয়ে আসেন। তাঁর অমাত্যরা রাত্রিবেলা আকবরের সেনার উপর চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে লুঠপাট করে রসদ সংগ্রহ করত।

এভাবেই ফরিদুন খান মানসিংহের সঙ্গে থাকা ভ্রাম্যমাণ কোষাগার লুণ্ঠন করে। শাহী ডাকবাহক কোষাগার-লুণ্ঠন দেখে ফেললে তারা দৌড়ে পালিয়ে যায়। এই সময় মানসিংহ মুরাদকে সঙ্গে নিয়ে কাবুল থেকে পনেরো ক্রোশ আগে ছোটা-কাবুলে পৌঁছে গিয়েছিলেন। ডাকবাহক সংবাদ পাঠাল— শাহী সেনা পরাজিত হয়েছে এবং আফগানরা পথ বন্ধ করে দিয়েছে।

এ কথা কিভাবে বিশ্বাস করতে পারেন মানসিংহ যদি পরাজিত হতো, তাহলে শত শত রণভঙ্গকারী সৈন্য অবশ্যই পালিয়ে আসত। তিনি সম্মুখে অগ্রসর হওয়াই উচিত বিবেচনা করেন। মির্জা যুদ্ধ করতে বাধ্য হয়েছিলেন, কিন্তু পরাজিত হয়ে পলায়ন ব্যতীত তাঁর কাছে আর কোনো উপায় ছিল না। মানসিংহ বিজয়-দুন্দুভি বাজাতে বাজাতে কাবুলে প্রবেশ করেন। সেই কাবুল, দশম শতাব্দীর অন্ত পর্যন্ত যা হিন্দুদের অধিকারে ছিল।

তারপর পৌনে ছয় শত বৎসর পর্যন্ত হিন্দু সেখানে গণনযোগ্য ছিল না। নিজেদের সংস্কৃতি ও দেশ রক্ষার জন্য পাঠানরা কয়েক শত বছর ধরে নিজেদের রক্ত ঝরিয়ে তখন তারা কট্টর মুসলমান, হিন্দুদের নাম শুনলেও ঘৃণা প্রকাশ করে। বুত্-খাকের (মাটির মূর্তির) জায়গায় বাদশাহের ডেরা বাঁধা হল। জয়লাভের পরে মির্জা হাকিমকে আকবরের সামনে হাজির করানো হয়। আকবর তাঁকে পুনরায় কাবুলের শাসক নিয়োগ করে সীমান্ত সুরক্ষার ভার দেন মানসিংহের উপর ।

সলীম মানসিংহের পিতৃসা-পুত্র, কছ্‌ওয়াহাদের দৌহিত্র ছিলেন। পরামর্শ করে স্থির হয়, ওই বংশেই যুবরাজের বিবাহ দিয়ে সম্পর্ককে আরও দৃঢ়তর করা হোক। ১৫৮৫ খ্রিস্টাব্দে রাজা ভগবানদাসের কন্যার সঙ্গে ষোড়শ বর্ষীয় সলীমের বিবাহ হয় । আকবর স্বয়ং বরানুগমন করেন।

দুই কোটি তঙ্কা মোহর (স্ত্রী-ধন) নির্ধারণ করে বিবাহ সম্পন্ন করা হয় এবং ব্রাহ্মণেরা তাঁদের অগ্নি-প্রদক্ষিণও করান। নববধূকে শ্বশুরালয়ে নিয়ে আসা হয় পালকিতে আশরফি বর্ষণ করতে করতে। রাজা ভগবানদাস কয়েক শত ঘোড়া, এক শত হাতি, কয়েক শত খুতনী-হাবসি চেরকাসী ও ভারতীয দাস-দাসী প্রদান করেন। আবুল ফজল আনন্দ প্রকাশ করে বলেছিলেন — দীনী দুনিয়া রা মুবারকবাদ কী ফখদ্ অদ্ । আজ বরায়ে ইতিজা দীনী দুনিয়া বস্তঃ অন্দ্‌৷ (দীন ও দুনিয়ার মঙ্গল হোক, যেহেতু দীন ও দুনিয়ার কল্যাণ-সাধনের নিমিত্তই এই বিবাহ সম্পন্ন করা হল।)

 

 শ্রেষ্ঠ সেনাপতি মানসিংহ | মানসিংহ | আকবর

এই সময় সংবাদ পাওয়া যায়, চরম মদ্যপান হেতু মির্জা হাকিম প্রাণত্যাগ করেছেন। মৃত্যুকালে (জুলাই, ১৫৮৫) তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র সাঁইত্রিশ বছর। মির্জার মৃত্যুর পরে কাবুলের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেওয়া হয় মানসিংহকে। দু’বছর পর্যন্ত তিনি সামরিক ও অসামরিক উভয় গুরুদায়িত্বই অত্যন্ত যোগ্যতার সঙ্গে পালন করেন।

বাদশাহ রাওয়ালপিণ্ডি এসেছিলেন। পুত্র জগৎসিংহকে কাবুলে রেখে মানসিংহ দরবারে হাজির হন। আকবর তাকে সীমান্ত এলাকা জায়গির হিসেবে প্রদান করেন এবং কাবুলের তত্ত্বাবধানের জন্য রাজা ভগবানদাসকে প্রেরণ করেন। অত্যল্পকালের মধ্যেই তিনি পাগল হয়ে যান। তার ফলে মানসিংহকে পুনরায় কাবুলে যেতে হয়।

১৫৮৭ খ্রিস্টাব্দে লাহৌরে মানসিংহের ভগ্নী সলীমের প্রথম পুত্র প্রসব করেন, তাঁর নাম রাখা হয় খুসরো। মসনদের উত্তরাধিকারী হিসেবেই তাঁর জন্ম হয়েছিল, কিন্তু নিজের অপদার্থ পিতার ঈর্ষার শিকার হতে হয় তাঁকে। যৌবনে পদার্পণ করে তিনি লাহৌরেই পিতার বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন এবং সেখানেই পিতার সম্মুখে তরবারির আঘাতে তাঁকে নিধন করা হয় ।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment