গুজরাত দৌড়, গুজরাতে পুরোপুরি শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। মুজফ্ফর মির্জা ও আতিয়ারুল মুলুকের হামলায় গুজরাতের বিপন্ন হওয়ার খবর আকবরের কাছে এসে পৌছায়। আকবরের বয়স তখন একত্রিশ বছর। যৌবনের তেজ চরম সীমায়।
গুজরাত দৌড় | গুজরাত বিজয় | আকবর
১৫৭৩ খ্রিস্টাব্দের ২৩শে আগস্ট (২৪শে রবিউস্-সানী, ৯৮১ হিঃ) তিনি কিছু বাছাই সৈনিক নিয়ে দ্রুতগামিনী উটে আরোহণ করে গুজরাত রওনা হন। বর্ষাকাল, কিন্তু বৃষ্টিপাতের অভাবে অসহ্য গরম। আকবর গড়ে প্রতিদিন পঞ্চাশ মাইল গতিতে পথ অতিক্রম করেন।
কখনো কখনো ঘোড়া ও রথেও আরোহণ করেন তিনি। আজমের, জালৌর, দীসা ও পাটনের পথ ধরে প্রায় ছয় শত মাইল এগারো দিনে অতিক্রম করে আহমদাবাদের নিকটে পৌছান। পাটন ও আহমদাবাদের মধ্য পথে অবস্থিত ছোট শহর বালিসনায় যাত্রা- বিরতি করে সেনা পর্যবেক্ষণ করেন।
সব মিলিয়ে তিন হাজার লোক ছিল, শত্রু- সৈন্যের সংখ্যা কুড়ি হাজার। তিনি এক শত সৈন্যকে নিজের দেহরক্ষী বেছে নেন; বাকি সৈন্যকে তিনটি ব্রিগেডে ভাগ করেন। মধ্য ব্রিগেড পরিচালনার ভার দিলেন আব্দুর রহীম খানখানাকে; যদিও তিনি তখন মাত্র ষোলো বছরের বালক। এ থেকেই বোঝা যায়, ১৫৬১ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারিতে বৈরাম খাঁর মৃত্যুর পর চার বছরের রহীমকে আকবর ধর্মপুত্র হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন এবং তাঁর শিক্ষা-দীক্ষায় কোনো ত্রুটি রাখেননি।
রহীম সর্বপ্রথম তার রণনৈপুণ্যের পরিচয় দেন এবং প্রবর্তীকালে আকবরের একজন বড় সেনাপতি হয়ে ওঠেন। এক দৌড়ে আকবরের সঙ্গে সাতাশ জন যোদ্ধা আমির ছিলেন, তাঁদের মধ্যে হিন্দু। লাল কলাওয়ন্ত ও সাওয়ল দাস, জগন্নাথ তথা তারাচন্দ— এই তিনজন চিত্রকর ছিলেন। সাওয়ল দাস (সাওলা) সরনালের যুদ্ধের চিত্রাঙ্কন পনেরো জন করেছিলেন, লণ্ডনের কেনসিংটন মিউজিয়মে একটি পাণ্ডুলিপিতে এখনও তা রয়েছে। লাল কলাওয়ন্ত প্রসিদ্ধ গায়ক বীরবলের নিকটে থাকতেন।
বাদশাহী সেনা আহমদাবাদের কয়েক মাইল দূরে সাবরমতীর তীরে পৌছায়। আশা ছিল, খানে- আজমের (কোকার) সেনা এসে তাদের সঙ্গে যোগ দেবে, কিন্তু তারা এল না। শত্রুরা ভেবেছিল— সিক্রী অনেক দূর, দুই সপ্তাহের আগে আকবর এখানে এসে পৌঁছতে পারবেন না। আকবরের সঙ্গে হাতি থাকে, সেই হাতিও সঙ্গে নেই। আহমদাবাদের নগরদ্বার দিয়ে বেরিয়ে খানে-আজম যাতে আকবরের সঙ্গে যোগ দিতে না পারেন, তা দেখার দায়িত্ব আতিয়ারুল-মুক্ নিজে নিয়েছিলেন ।
মুহম্মদ হুসেন মির্জা দেড় হাজার বিদ্রোহী মোগলের মোকাবিলার জন্য তৈরি ছিলেন। নগরের ভিতরে সৈন্যদের আসার প্রতীক্ষা না করে আকবর জবরদস্তি ঘোড়ায় আরোহণ করে নদীর দিকে অগ্রসর হন। সকলেই তাঁর পিছনে পিছনে যেতে থাকে। আকবর স্রেফ দু’জন দেহরক্ষী কাছে রেখেছিলেন। বাদশাহী ঘোড়া আহত হয়। খবর ছড়িয়ে পড়ে, আকবরের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু সেই রটনায় কোনো ফল হয়নি, কেননা আকবর তখন মির্জার সঙ্গে যুদ্ধরত, মুহম্মদ হুসেন মির্জা আহত হয়ে বন্দী হন।
আকবর জয়লাভ করেন। নিজের পাঁচ হাজার সৈন্য নিয়ে আতিয়ারুল-মুল্ক পাশা ওল্টাতে চাইলেন। কিন্তু তিনিও নিহত হন । আহত মির্জাকে কতল করার হুকুম দিতে আকবর ইতস্তত করছিলেন, কিন্তু লোকজন পরামর্শ দিল এই কালসাপ পুষে রাখা ঠিক নয়। মির্জাকে স্বর্গে পাঠিয়ে দেওয়া হল । যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পরেই খানে-আজম এসে উপস্থিত হলেন ।
এইভাবে ১৫৭৩ খ্রিস্টাব্দের ২রা সেপ্টেম্বর আকবর গুজরাতের ভয়ঙ্কর বিদ্রোহ দমন করেন। সেখানে তৈমূরী রেওয়াজ অনুযায়ী দুই হাজার চূড়া-বিশিষ্ট মিনার তৈরি করা হয়। শাহ মদদ রাজা ভগবানদাসের ভ্রাতা ভূপতকে সরনালে হত্যা করেছিলেন, তার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আকবর স্বহস্তে তাঁর মাথা ধড় থেকে বিচ্যুত করে দেন।
মির্জা ভ্রাতাদের মধ্যে শাহ মির্জা প্রাণ বাঁচিয়ে পালিয়ে যেতে পেরেছিলেন, কিন্তু তিনি আকবরের কোনো ক্ষতি করতে পারেননি। গুজরাতের এই দ্বিতীয় জয়লাভের পর আকবর তিন সপ্তাহ যাত্রা করে ফতেহপুর-সিক্রী পৌছান। সমগ্র অভিযান সমাপ্ত হয় তেতাল্লিশ দিনে, আকবর সিক্রীতে (তখন ফতেহপুর-সিক্রী) প্রবেশ করেন ১৫৭৩. খ্রিস্টাব্দের ৫ই অক্টোবর । গুজরাতের ভূমিরাজস্ব-ব্যবস্থা অত্যন্ত খারাপ হয়ে পড়েছিল। তার বন্দোবস্ত করতে টোডরমলকে পাঠানো হয়. তিনি ছয় মাসের মধ্যে গুজরাতের জমি জরিপ করে রাজস্ব-আদায়ের সুবন্দোবস্ত করে ফেলেন। সরকারি ব্যয় বাদ দিয়ে বাৎসরিক পঞ্চাশ লক্ষ টাকা রাজস্ব গুজরাতের শাহী কোষাগারে জমা পড়তে থাকে ।
রাজা টোডরমলের পর ঠিকঠাক মতো কাজ চালানোর জন্য দ্বিতীয় অর্থ-বিশেষজ্ঞ শাহাবুদ্দীন আহমদ খাঁকে ১৫৭৭ থেকে ১৫৮৩-৮৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত গুজরাতের উপরাজ করা হয়। শাহাবুদ্দীন গুজরাতকে ষোলোটি সরকারে (জেলায়) বিভক্ত করেন।
গুজরাতের জয়লাভ স্থায়ী হয়েছিল। হয়তো কখনো-সখনো ছোট-খাটো বিদ্রোহ দেখা দিয়েছিল, নইলে ১৫৭৩ খ্রিস্টাব্দের বিজয়ের পর থেকে ১৭৫৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত গুজরাত মোগল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত সুবা ছিল। শেষে মারাঠারা মোগলদের হাত থেকে তা ছিনিয়ে নেয় ।
১৫৭৪ খ্রিস্টাব্দে সারঙ্গপুরের (আহমদাবাদ, গুজরাত) হাকিম মুজফ্ফর খাঁ তুরবর্তীকে ডেকে এনে আকবর তাঁকে নিজের ওয়াকীল (প্রধানমন্ত্রী) করে টোডরমলকে তাঁর অধীনে কাজ করার নির্দেশ দেন। তখন আকবরের প্রশাসন-ব্যবস্থা সঠিক রূপ নিতে শুরু করে।
এই সময় সরকারী কাজে নিযুক্ত ঘোড়ায় দাগ দেওয়ার প্রথা চালু হয়, মনসব (পদ) সুবিন্যস্ত করা হয় এবং শাহী (খালসা) ভূমিব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় । আগেই বলা হয়েছে, মনসবদার ও তার অধীনস্থ অমাত্যদের পদানুযায়ী ঘোড়া রাখা বাধ্যতামূলক ছিল এবং ঘোড়ার সংখ্যানুপাতে তারা শাহী কোষাগার থেকে টাকা পেত। কিন্তু তারা কম ঘোড়া রেখে টাকা আত্মসাৎ করত।
পরিদর্শনকালে তারা একই ঘোড়া বিভিন্ন জায়গায় দেখানোর কারচুপি করত। সেটা বন্ধ করার জন্য ঘোড়ার উপর জ্বলন্ত লোহার ছাপ দেওয়ার নিয়ম চালু করা হয়। আলাউদ্দীন খিলজী ও শেরশাহও এই নিয়ম জারি করেছিলেন । যথোচিত দক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে না পারার জন্য মুজফ্ফর খাঁর তাঁর পদ থেকে অপসারণ করা হয় ।

ইব্রাহিমের পুত্র মুজফ্ফর হুসেন মির্জার উপদ্রবের সময় তাঁকে দমন করার জন্য ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে টোডরমলকে গুজরাত পাঠানো হয়। সবেমাত্র টোডরমল বাংলায় সফল অভিযান সেরে তিন শত চারটি হাতি নিয়ে দরবারে ফিরেছিলেন। ওয়াজির খাঁকে সাহায্য করার জন্য তাঁকে গুজরাত দৌড়াতে হয়।
১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবরে তাঁর জায়গায় খাজা শাহ মনসুর শিরাজীকে অস্থায়ী অর্থমন্ত্রী নিযুক্ত করা হয়। মনসুর অত্যন্ত যোগ্য ব্যক্তি ছিলেন। নিজের যোগ্যতায় তিনি একজন সাধারণ মুনশী থেকে এমন উচ্চপদে আরোহণ করতে পেরেছিলেন।
ষড়যন্ত্র করার কারণে ১৫৮১ খ্রিস্টাব্দে তাঁর প্রাণদণ্ড হয়, ততদিন পর্যন্ত তিনি ছিলেন টোডরমলের প্রতিদ্বন্দ্বী। টোডরমল মুজফ্ফর মির্জাকে দমন করে গুজরাতে শান্তি স্থাপন করে ১৫৭৭ খ্রিস্টাব্দের শেষার্ধে বহু বিদ্রোহী বন্দীকে নিয়ে দরবারে ফিরে আসেন। তখন থেকে বাদশাহের মন্ত্রী হিসেবে তাঁকে সমগ্র সাম্রাজ্যের ব্যবস্থাপনার কাজে রত হতে হয়।
এই বছরেই নভেম্বরে আকাশে ধূমকেতু দেখা যায়। ধূমকেতু ছত্রভঙ্গের সঙ্কেত বহন করে, এ-বিশ্বাস এখনও আছে। শাহ তহমাম্পের মৃত্যুর (১৫৭৬ খ্রিঃ) পর তাঁর উত্তরাধিকারী শাহ ইসমাইলের হত্যাকাণ্ড তার প্রমাণ হিসেবে স্বীকার করা হতো। ভারতেও কিছু মানুষের উপরেও এ-বিশ্বাসের প্রভাব রয়েছে।
আরও দেখুনঃ