Site icon History Gurukul [ ইতিহাস গুরুকুল ] GDCN

গুজরাতের প্রথম বিজয় | গুজরাত বিজয় | আকবর

গুজরাতের প্রথম বিজয় | গুজরাত বিজয় | আকবর

গুজরাতের প্রথম বিজয়, হুমায়ূন স্বল্পকালের জন্য গুজরাত অধিকার করেছিলেন ঠিকই, তবে সেখানে যেহেতু আগে থেকেই একটা পৃথক সুলতানি কায়েম হয়ে যায়, যার প্রভাব ছিল স্থানীয় মানুষের উপর, সেহেতু হুমায়ূনের হাত-ছাড়া হতে অধিক বিলম্ব হয়নি। আকবর উত্তরে তাঁর শাসন সুদৃঢ় করে নিয়েছিলেন, এবার তাঁর মনোযোগ আকৃষ্ট হয় গুজরাতের দিকে।

গুজরাতের প্রথম বিজয় | গুজরাত বিজয় | আকবর

 

 

আগে আমরা দেখব, সন্ত সলীম চিশতীর প্রভাব ও পুত্র-লাভের কারণে আকবর তাঁর রাজধানী আগরা থেকে সিক্রীতে ১৫৭১ খ্রিস্টাব্দে স্থানান্তরিত করেন এবং চোদ্দ বছর পর্যন্ত সিক্রীই ছিল আকবরের শাসন কেন্দ্র। গুজরাত-বিজয় উপলক্ষ্যে সিক্রীর নাম হয় ফতেহপুর (বিজয়নগর)।

আকবর ১৫৭২ খ্রিস্টাব্দের ৪ঠা জুলাই বর্ষাকালে সিক্রী থেকে গুজরাত অভিযান করেন। গুজরাতে তখন মুজফ্ফরশাহ নামে-মাত্র সুলতান ছিলেন । তাঁর জায়গিরদাররা নিজের নিজের এলাকার ভূস্বামী ছিলেন, তাঁরা নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ- বিগ্রহে লিপ্ত ছিলেন । তাঁদের মধ্যে এতমাদ খাঁ-ও ছিলেন, তিনি গুজরাতের দুরবস্থা দেখে আকবরকে ডেকে পাঠান। গুজরাতে সুরাত, খম্ভাত ইত্যাদি অনেক বিখ্যাত বন্দর ছিল। সামুদ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য গুজরাতকে খুব ধনী প্রদেশে পরিণত করেছিল। আকবরের গুজরাত অধিকারের ফলে তাঁর সাম্রাজ্যের সীমা সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত হওয়ার সম্ভাবনা ।

১৫৬৯ খ্রিস্টাব্দের ৩০শে আগস্ট কছওয়াহার রাজকন্যার গর্বে আকবরের জ্যেষ্ঠ পুত্র সলীমের জন্ম হয়, পররর্তীকালে যিনি জাহাঙ্গির নাম ধারণ করে সিংহাসনে বসেন । গুজরাত-যাত্রার সময় আকবর যখন আজমের ও নাগৌরের মধ্যে ফালওয়দিতে অবস্থান করছিলেন, তখন তাঁর দ্বিতীয় পুত্র দানিয়ালের জন্ম হয়। সেপ্টেম্বরে আকবর নাগৌরে ঘাঁটি গাড়েন। পিছন থেকে কেউ যাতে আক্রমণ করতে না পারে, সেজন্য আকবর দশ হাজার সওয়ার সহ খানেকলা মীর মুহম্মদ খাঁ আতকাকে মারওয়াড়ের দিকে প্রেরণ করেন।

সিরোহী ছিল দেওরা-চওহানদের। সেখানকার দেড় শত রাজপুত নতিস্বীকারের বদলে তরোয়ালের সামনে প্রাণ-বিসর্জন দেওয়াই কাম্য মনে করে। আকবর নিশ্চিন্ত হয়ে ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বরে গুজরাতের রাজধানী আহমদাবাদের নিকটে পৌছান। মুজফ্ফরশাহ পালিয়ে একটা ক্ষেতে লুকিয়ে থাকার সময় ধরা পড়েন। আকবর তাঁকে ছোট একটা জায়গির দিয়ে দেন। বাদশাহের কিছু লোক রসদসামগ্রীতে হাত দিয়েছিল বলে তাদের হাতির পায়ে পিষে মারা হয় ।

কিছু সৈন্য নিয়ে আকবর খম্ভাত যান, সেখানে সর্বপ্রথম কিছুক্ষণ সমুদ্রবিহার করেন। সেখানে পোর্তুগিজ বণিকরা ভেট নিয়ে আসে। ইউরোপীয় বণিকদের সঙ্গে আকবরের সেটা প্রথম সাক্ষাৎকার। আকবর গুজরাতের সুবেদার (এই পদের নাম পরবর্তীকালে, আকবরের সময় প্রদেশের শাসনকর্তাকে বলা হতো সিপাহসালার) করেন মির্জা আজীজ কোকাকে। এই সময় সংবাদে আসে, তৈমূরী মির্জা ইব্রাহিম হুসেন আকবরের আমির রুস্তম খাকে হত্যা করে সামনে আগ্রসর হতে চাইছেন।

মির্জারা সুরাতকে নিজেদের গড় তৈরি করে রেখেছিল। বড়োদার নিকট থেকে আকবর একটা ছোট সেনাবাহিনী নিয়ে ইব্রাহিমের বিরুদ্ধে অভিযান করেন। মাহী নদীর ঘাটে উপস্থিত হয়ে আকবর জানতে পারেন, মির্জা যথেষ্ট বড় এক সেনাবাহিনী নিয়ে নদীর অপর তীরে সরনাল শহরে ঘাঁটি গেড়েছেন।

লোকজন পরামর্শ দিলো, কুমকে পৌঁছে আক্রমণ করা উচিত, তবে আকবর আচমকা মির্জার উপর চড়াও হতে চাইছিলেন। লোকজন রাত্রিবেলা আক্রমণ করার রায় দিলো। আকবর জানালেন, সেটা বীরোচিত নয়। আকবরের সঙ্গে ছিল মাত্র দুই শত সৈনিক, তাদের মধ্যে মানসিংহ, রাজা ভগবানদাস এবং অনেক সর্দারও ছিলেন। সরনালের সঙ্কীর্ণ গলিপথে বড় সেনাবাহিনী নিয়ে মির্জার কোনো লাভ হয়নি। আকবর নিজে যুদ্ধ করছিলেন। সেখানে ভগবানদাসের ভ্রাতা ভূপত নিহত হন। তিনজন শত্রু-সৈন্য আকবরকে ঘিরে ফেলে।

 

 

ভগবানদাস একজনকে বর্শার এক আঘাতে ঘায়েল করে দেন, বাকি দু’জনের মধ্যে একজনের শক্ত মোকাবিলা করেন আকবর। পরাজিত হয়ে মির্জা পলায়ন করেন। রাত্রিবেলা মোগল সেনা তাঁর পশ্চাদ্ধাবন করতে সক্ষম হয়নি। ২৪শে ডিসেম্বর আকবর তাঁর শিবিরে প্রত্যাবর্তন করেন। ভগবানদাস একটি পতাকা ও নাকাড়া পুরস্কার লাভ করেন। সেই পুরস্কার সেই প্রথম কোনো হিন্দু পুরস্কৃত হন ।

সুরাত বাকি রইল। রাজা টোডরমল শত্রুর শক্তি সম্বন্ধে অনুসন্ধান করতে লাগলেন। ডিসেম্বর শেষে আকবর বড়ৌদা থেকে যাত্রা করেন। ১৫৭৩ খ্রিস্টাব্দের ১১ই জানুয়ারি মোগল সেনা সুরাত অবরোধ করল। গোয়া থেকে পোর্তুগিজরা সুরাতকে সাহায্য করতে এসেছিল, কিন্তু যখন জানতে পারল, সুরাতের পতন অবধারিত, তখন তারা আকবরের দরবারে উপঢৌকন পাঠাল। আকবর ফিরিঙ্গিদের যুদ্ধ-জাহাজের ক্ষমতা বিষয়ে অনেক কথা আগেই শুনেছিলেন।

তাঁর আশঙ্কা ছিল, পোর্তুগিজ রণতরী না আক্রমণ করে বসে, সেজন্য তিনি গোয়ার উপরাজ আন্তোনিও দে নরোন্হার সঙ্গে আপস-আলোচনা করে খুবই সন্তুষ্ট হন। খম্ভাতে পোর্তুগিজদের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের পর ধর্ম-কৌতূহল নিবৃত্তির জন্য পোর্তুগিজ পাদরীদের সৎসঙ্গ লাভের সুযোগ পান তিনি।

হাজীরা খম্ভাত অথবা সুরাত থেকে সমুদ্রপথে মক্কা যাত্রা করতেন। আরব সাগরের উপর অধিকার ছিল পোর্তুগিজদের। এই আপসের ফলে হাজীদের যাত্রা সুরক্ষিত হয় । আকবর নিজে ব্যয় বহন করে কয়েক বছর পর্যন্ত হাজীদের বড় বড় দলে মক্কা প্রেরণ করতেন।

দেড় মাস অবরোধের পর ১৫৭৩ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে ফেব্রুয়ারি সুরাত আত্মসমৰ্পণ করে। শত্রুপক্ষের সেনাপতি হমজওয়ান পূর্বে হুমায়ূনের রাজকার্য-সেবায় নিযুক্ত ছিলেন। আকবর তাঁর প্রাণভিক্ষা দেন, কিন্তু বাদশাহের সম্মুখে মুখে গর্হিত উচ্চারণের জন্য তাঁর জিভ কেটে ফেলার হুকুম দেন।

 

 

এখানেই মদ্যপানের আসরে নিজের বীরত্বের পরিচয় দিতে গিয়ে আকবর শব্দ অন্যদের সঙ্গে নিজেও দেওয়ালে তরোয়াল আটকে তার ডগায় দূর থেকে দৌড়ে এসে বুকে ধাক্কা মারতে চেয়েছিলেন, মানসিংহ সেই তরোয়াল দেওয়াল থেকে খসিয়ে ফেলে দেন। তাতে আকবর তাঁকে ভূপাতিত করে গলা টিপে মারতে যান, উপস্থিত লোকজন বাদশাহকে টেনে এনে মানসিংহের প্রাণ বাঁচায়।

পিতা-পিতামহের আমল থেকেই পানোন্মত্ততা চলে আসছিল। আকবরের দুই পুত্র মুরাদ ও দানিয়াল এবং সৎ-ভ্রাতার মৃত্যু হয় অত্যধিক মদ্যপান হেতু। পরবর্তীকালে আকবর মদ্যপান কমিয়ে তাড়ি ও আফিমে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। জাহাঙ্গিরও অত্যন্ত পানাসক্ত ছিলেন। সুরাত- বিজয়ের পর আকবর প্রত্যাবর্তন করেন। ১৫৭৩ খ্রিস্টাব্দের ১৩ই এপ্রিল সৈন্যরা এসে পৌঁছলে জানা যায়, আহত হয়ে ইব্রাহিম হুসেন মির্জার মৃত্যু হয়েছে।

আরও দেখুনঃ

Exit mobile version