Site icon History Gurukul [ ইতিহাস গুরুকুল ] GDCN

 চিতৌড় রণথম্ভৌর বিজয় | রাজ্যবিস্তার | আকবর

 চিতৌড় রণথম্ভৌর বিজয় | রাজ্যবিস্তার | আকবর

চিতৌড় রণথম্ভৌর বিজয়:

 চিতৌড় রণথম্ভৌর বিজয় | রাজ্যবিস্তার | আকবর

 

 

(১) চিতৌড় অধিকার (১৫৬৭ খ্রিঃ)— যখন অন্য কোনো বিপদ-আপদ থাকত না, তখন আকবর কোনো যুদ্ধের কথা ভাবতেন। তখন তার বয়স পঁচিশ বছর । কছওয়াহাদের সঙ্গে বিবাহ-সম্বন্ধ স্থাপন পাচ বছর হয়ে গেছে। চিতৌড়ের সিসোদিয়া, রাজপুতদের শিরোমণি বলে গণ্য হতো। যতদিন না বাবর রানা সাঁগাকে পরাজিত করতে সক্ষম হন, ততদিন তিনি নিজের সিংহাসন সুরক্ষিত মনে করতেন না। মেওয়াড়ের দিকে আকবরের মনোযোগ দেওয়া আবশ্যক ছিল।

অজুহাত পেতে কোনো অসুবিধে হল না। রানা মালওয়ার সুলতান বাজবাহাদুরকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। রানার পুত্র শক্তসিংহ আকবরের দরবারে থাকতেন। তখন আকবরের শিবির স্থাপিত হয়েছিল ধওলপুরে। একদিন ঠাট্টা করে তিনি শক্তসিংহকে বললেন— “ভারতের অধিকাংশ রাজা, নামজাদা লোকেরা আমার প্রতি তাদের সম্মান প্রকাশ করেছেন, রানা তা করেননি।

তাঁকে দণ্ড দেওয়ার জন্য আমি যেতে চাই।” শক্তসিংহ তখন আর কি জবাব দেবেন? তিনি দৌড়তে দৌড়তে গিয়ে তাঁর পিতা উদয়সিংহকে সেই সংবাদ দিলেন। বিনা হুকুমে শক্তসিংহের চলে যাওয়া আকবর ভালো মনে গ্রহণ করলেন না। তিনি তাঁর সিদ্ধান্তকে চূড়ান্ত করে ফেললেন। তৈমূরী মির্জারা মালওয়ার জোর লুঠপাট চালাচ্ছিল। আকবর তাঁদের দমন করার জন্য সেনাপতিদের নির্দেশ দিয়ে নিজে চিতৌড়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযান করলেন ।

সওয়া তিন মাইল দীর্ঘ ও প্রায় বারো শত গজ প্রস্থ এক পাহাড়ের উপর নির্মিত চিতৌড়ের অজেয় দুর্গ। নিচে আট মাইল দৈর্ঘ্যের কাছাকাছি, চার-পাঁচ শত ফুট উঁচু পাহাড়ের বেষ্টনী। চিতৌড়ের সম্মুখে পূর্বদিকে একটা ছোট মতো পাহাড়ী চিতৌড়ী। দুর্গে প্রবেশ করার কয়েকটি দ্বার ছিল, সেগুলোর মধ্যে পশ্চিমে রামপোল, পূর্বে সুরজপোল এবং উত্তরে লখৌতাপোল দ্বার। দুর্গের অভ্যন্তরে কয়েকটি পুষ্করিণী ছিল, তার ফলে সেখানে জলের কোনো কষ্ট হতো না ।

রানাকে সিসোদিয়া ও গুহিলওত বলা হতো। গুহিল ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষে এই বংশের মূল রাজা ছিলেন। ৭২৮ খ্রিস্টাব্দে বাপ্পা রাওয়ল মওরী (মৌর্য) বংশের কাছ থেকে রাজ্য কেড়ে নেন। এ কথাও বলা হয় যে গুহিল বড়নগরের (আনন্দপুর, গুজরাত) নাগর ব্রাহ্মণ ছিলেন।

নাগর ব্রাহ্মণ থেকে সূর্যবংশী ক্ষত্রিয়ের কিভাবে উদ্ভব হল, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ইতিহাসে এরূপ ওলট-পালট বহু ঘটেছে। এমন কথাও চালু আছে যে বলভীর পুরাতন রাজবংশ তথা গুজরাতের মেড়দের সঙ্গে রানার বংশের সম্পর্ক ছিল। খুসরো নওশেরওয়ার কন্যাও এই বংশের মাতাদের অন্যতমা ছিলেন।

বংশ-প্রতিষ্ঠাত্রী এক রাজমাতা বিধবা ব্রাহ্মণী ছিলেন, এ কথাও বলা হয়ে থাকে। মেওয়াড়েরা কয়েক পুরুষ ধরে আত্মসম্মানের জন্য রক্তের হোলি খেলেছিল, সেজন্যই ভারতে এই বংশের সম্মান সর্বোচ্চ বলে গণ্য হতো । রানা সাঁগা বাবরের কঠোর বিরোধিতা করেছিলেন। বাবরের মৃত্যুর এক বছর পূর্বে ১৫২৯ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হয়। পিতার মৃত্যুর পর জন্ম হয়েছিল উদয়সিংহের, তিনিই এখন রানা সাঁগার  গদিতে অধিষ্ঠিত।

সামনে। সমগ্ৰ মোগল সাম্রাজ্যের সামরিক শক্তি নিয়ে তিনি এসেছিলেন। দশ মাইল তিনটির ১৫৬৭ খ্রিস্টাব্দের ২০শে অক্টোবর আকবর তাঁর শিবির স্থাপন করেন চিতৌড়ের জুড়ে ছিল মোগল সেনা। দুর্গের দিকে মুখ করে বসানো হয় তিনটি কামান । মধ্যে একটি লখৌতাপোল দুর্গদ্বারের সম্মুখে।

রাজা টোডরমলকে অন্য কামান দুইটির দায়িত্বে নিযুক্ত করা হয়। আকবর তাঁর সামনে আধ মণ ভারি গোলা নিক্ষেপ করান। কয়েকবার আক্রমণ করে অনেক ক্ষয়ক্ষতির সঙ্গে মোগল সেনাকে পিছু হঠতে হয়। তখন সুড়ঙ্গ পথ নির্মাণ ব্যতীত অন্য কোনো উপায় ছিল না। হাতি দাড়ানো অবস্থায় যেতে পারে এমন সুড়ঙ্গ তৈরি করা হল।

দুইটি বারুদের মাইল রাখা হল, তাতে পলিতা সংযোগ করা হল, কিন্তু দুইটির একটিরও বিস্ফোরণ হল না। সৈন্যরা ভিতরের দিকে দৌড়ায়, সেই সময় অন্য সুড়ঙ্গ বেরিয়ে পড়ে। দুই শত লোক প্রাণ হারায়, তাদের মধ্যে বারার এক সৈয়দও ছিল।

আকবরের দ্রুত সাফল্যলাভের আশা রইল না। তিনি ধৈর্য-সহকারে কার্যোদ্ধার করতে মনস্থ করলেন। রাজা টোডরমল ও কাসিম খাঁ অপর সুড়ঙ্গটি তৈরি করেছিলেন (এই কাসিম খাঁ-ই আগরার দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন)। আকবর স্বয়ং আহার-নিদ্রা ত্যাগ করে সুড়ঙ্গ নির্মাণের তত্ত্বাবধান করতেন।

১৫৬৮ খ্রিস্টাব্দের ২৩শে ফেব্রুয়ারি আকবর দুর্গের দিকে লক্ষ্য রাখছিলেন। চোখে পড়ে, একজন সর্দার ভাঙা দুর্গপ্রাচীর দেখাশোনা করছেন। তাঁর অজান্তেই আকবর তাঁর বন্দুক ‘সংগ্রাম’ দিয়ে গুলি করলেন। এক ঘণ্টার মধ্যেই প্রতিরক্ষা সেখান থেকে সরে গেল, দুর্গের মধ্যে কয়েক জায়গায় আগুন জ্বলতে শুরু করল। রাজা ভগবানদাস জানালেন— অন্তঃপুরের রানীরা আত্মসম্ভ্রম রক্ষার জন্য আগুনে ঝাঁপ দিচ্ছেন। পরদিন সকালে জানা গেল, আকবর যে সর্দারকে হত্যা করেছেন, তিনি ওয়েদনওয়রের রাঠৌর বীর জয়মল ছিলেন। উদয়সিংহ দুর্গ ত্যাগ করে চলে যাওয়ার পর প্রতিরক্ষার দায়িত্বভার তিনি নিজের কাঁধে নিয়েছিলেন।

জয়মলের পর দুর্গের দায়িত্ব নেন ক্যায়লওয়ার সর্দার পত্তা, তখন তাঁর বয়স মাত্র ষোলো বছর। পত্তার পিতার মৃত্যু হয়েছিল আগেই। পুত্রের কথা ভেবে তাঁর মাতা চিতায় স্বামীর সহগমন করেননি । মাতা স্বয়ং পুত্রকে বললেন: জাফরানী রঙের পোশাক পরো, চিতৌড়ের জন্য প্রাণ দাও। তিনি নিজেও সেইভাবে পুত্রবধূকে নিয়ে রণাঙ্গনে ঝাঁপিয়ে পড়েন, অন্যান বহু ক্ষত্রিয়াণী তাঁদের অনুসরণ করেন।

শ্বশুর সম্মুখে পুত্রবধূ ভূলুণ্ঠিত হন। যুদ্ধ করতে করতে পত্তা প্রাণদান করেন। জহর-অনুষ্ঠানের পরদিন আকবর দুর্গের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। আবুল ফজল লিখেছেন— “পরমপুজনীয় আমাকে জানান, যখন তিনি গোবিন্দ শ্যাম মন্দিরের নিকটে পৌঁছান, তখন একজন মহাবীর তাঁর হাতির পায়ে একটি লোককে পেষণ করাচ্ছিল।

প্রশ্নের উত্তরে মহাবীর জানাল যে সে লোকটার নাম জানে না। কিন্তু আকবরের মনে হয় লোকটা কোনো এক সর্দার, কেননা তার সঙ্গে বহু লোক যুদ্ধ করতে করতে প্রাণ দেয়। শেষে জানা যায়, লোকটা হলেন পত্তা। তাকে বাদশাহের সম্মুখে নিয়ে আসা হয়।

তখনও তার দেহে প্রাণ ছিল, কিছুক্ষণের মধ্যেই মৃত্যু হয়।” আবুল ফজলের মতে, তিন শত নারী জহর- ব্রতে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন। দুর্গে প্রবেশ করার সময় আট হাজার রাজপুত তাঁদের প্রাণের মায়া করেননি। এরূপ বীরত্বের প্রতি আকবরের শ্রদ্ধা জানানো উচিত ছিল, কিন্তু ততক্ষণে যা ঘটবার ঘটে গেছে।

 

 

তিনি গণহত্যার হুকুম দেন। ত্রিশ মহামূল্যবান হাজার লোকের প্রাণ যায়। কথিত আছে, নিহতদের উপবীত ওজন করা হয়, ওজন হয়েছিল সাড়ে চুয়াত্তর মণ (১ মণ = ৪০ সের)। আমাদের দেশে হাল আমলেও নিজের গোপন পত্রের উপর ৭৪।। সংখ্যাটি লেখা হয়ে থাকে, তার অর্থ : যদি কোনো অনধিকারী এই পত্র পাঠ করে, তাহলে তার এত নরহত্যার পাপ হবে।

এইভাবে ১৫৬৭ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারিতে আকবর বরাবরের জন্য জনশূন্য চিতৌড় অধিকার করেন। চার বছর পরে গোগুণ্ডায় রানা উদয়সিংহের মৃত্যু হয় এবং সিসোদিয়ার পতাকা সুদৃঢ় হস্তে গ্রহণ করেন তার পুত্র রানা প্রতাপ, আকবর তাঁকে কখনও মাথা নত করাতে পারেননি। জাহাঙ্গির চিতৌড় পুননির্মাণ করতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন। হুকুম অমান্য করার জন্য ১৬৫৩ খ্রিস্টাব্দে শাহজাহান নিজে গিয়ে মেরামত-করা অংশ ভেঙে দেন।

১৬৮০ খ্রিস্টাব্দের ৪ঠা মার্চ ঔরঙ্গজেব চিতৌড় পৌঁছে সেখানে সৈন্য-শিবির স্থাপন করেন। এই সময় তিনি সেখানকার তেষট্টিটি মন্দির ধ্বংস করেন। দেওকুলে রানাদের মূর্তি রাখা ছিল, সেগুলোও চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেন তিনি।

 ১৭৪৪ অথবা ১৭৪৫ খ্রিস্টাব্দে খ্রিস্টান সন্ত স্টিফেন টলার বন্যন্তুতে পরিপূর্ণ চিতৌড় দেখেছিলেন। কিছু সাধু তখনও সেখানে ছিলেন। মোগল সাম্রাজ্য ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়ার সময় চিতৌড় পুনরায় রানার হাতে আসে। চিতৌড় বিনাশ হওয়ার সময় সেখানকার লৌহকারেরা এই প্রতিজ্ঞা করে চিতৌড় ত্যাগ করেছিল যে তারা কোথাও স্থায়ীভাবে বসবাস করবে না । নিজেদের গাড়িকেই ঘর বানিয়ে এই ভবঘুরেরা (গাড়িওয়ালা লোহার) চার শতাব্দী ধরে নানা জায়গায় ঘুরে বেরিয়েছে এবং ভারতে স্বাধীনতার পরেই তারা পুনরায় চিতৌড়ে ফিরে যায় ৷

আকবর যদিও সে-সময় ভুল করেছিলেন, তবু তিনি রাজপুতদের বীরত্ব বিস্মৃত হননি। তিনি জয়মল ও পত্তার সুন্দর মূর্তি তৈরি করিয়ে আগরা দুর্গে স্থাপন করেন। ঔরঙ্গজেবের শাসনকালের শুরুতে ১৬৬৩ খ্রিস্টাব্দে ফরাসী যাত্রী বার্নিয়ের সেই মূর্তিগুলো দিল্লীর দুর্গদ্বারে দেখেছিলেন।

শাহজাহান ১৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে এই দুর্গের সংস্কার শুরু করেন এবং দুর্গদ্বারে মূর্তিগুলো স্থাপন করেন। ঔরঙ্গজেবের কেন তা পছন্দ হবে? বার্নিয়েরের চলে যাওয়ার কিছুদিন পরেই তিনি সেগুলো ভেঙে ফেলেন ৷ রানা অমরসিংহ ও তাঁর পুত্র করণসিংহ যখন জাহাঙ্গিরের অধীনতা স্বীকার করেন, তখন তাঁদের দুইটি মর্মর মূর্তি জাহাঙ্গির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, ১৬১৬ খ্রিস্টাব্দে আজমেরে থাকার সময় সেগুলো তৈরি করিয়ে তিনি আগরায় নিয়ে যান।

আকবর চিতৌড় আক্রমণ করার সময় খাজা আজমেরীর নিকট মানত করেছিলেন : জয়লাভের পর তিনি সেখান থেকে পায়ে হেঁটে গিয়ে আজমের-শরীফ জিয়ারত করবেন। সেই মতো ২৮শে ফেব্রুয়ারি তিনি আজমের উদ্দেশে পদব্রজে রওনা দেন।

দেখাদেখি কেবল বহুসংখ্যক আমির নন, এমনকি বেগমরাও পায়ে হেঁটে যাত্রা শুরু করেন। ফেব্রুয়ারির শেষে তখন গরম পড়ে গেছে। খুব কষ্টে তাঁরা চিতৌড় থেকে চল্লিশ মাইল দূরে মাডলে পৌছান, সেখানে সকলে অবসন্ন হয়ে পড়েন। ডুবন্ত মানুষের যেমন খড়কুটো সম্বল, আজমের থেকে তেমনি এক দূত এসে জানায় : খাজা স্বপ্ন দিয়েছেন, বাদশাহের সওয়ারিতে যাওয়া উচিত।

সকলেই সওয়ারিতে চড়ে বসলেন, কেবল শেষ পথটুকু পায়ে হেঁটে যাত্রা করেন। জিয়ারতের পরে মার্চ মাসে (১৫৬৮ খ্রিঃ) আকবর আগরায় প্রত্যাবর্তন করেন। পথে দুইটি বাঘ শিকার করেন, একটা লোকেরও মৃত্যু হয়। কালিঞ্জর, চিতৌড় ও রণথম্ভৌরকে অজেয় দুর্গ বলে গণ্য করা হতো। চিতৌড় অধিকারের পর আকবরের অভিপ্রায় ছিল রণথম্ভোরও হস্তগত করা। কিন্তু এই সময় তৈমূরী মির্জাদের এবং ধাত্রী-মাতা জীজী আনগার (শামশুদ্দীনের পত্নী) বংশধর— আতকাখেল-এর দুষ্কর্মের বিষয় এসে পড়ে। প্রথমে তিনি এর বিহিত করা উচিত মনে করেন।

১৫৬২ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে শামশুদ্দীনের হত্যাকারী আদহম খাঁ কিরূপ দণ্ডপ্রাপ্ত হয়েছিলেন, সে কথা আমরা আগেই উল্লেখ করেছি। জীজী আনগার পুত্র মির্জা আজীজ কোকা (পরবর্তীকালে খানে আজম) আকবরের দুগ্ধভ্রাতা ও প্রীতিভাজন ছিলেন।

আতকাখেল পাঞ্জাবের জায়গির পেয়েছিলেন। সেখানে তাঁকে বেশি দিন রাখা সমীচীন নয় ভেবে আকবর তাঁকে ফিরিয়ে এনে অন্যত্র জায়গির নিতে বাধ্য করেন। কেবল মির্জা কোকার জায়গির দীপালপুর (দেওপালপুর, জেলা মটগোমরী) বহাল রাখেন, বাকিদের কাউকে রুহেলখণ্ডে নিয়ে গিয়ে ফেলেন, কাউকে অন্য জায়গায়। তখন পাঞ্জাবের সুবেদারি দেওয়া হয় খানজাহান হুসেন কুল্লি খাঁকে। অর্থ বিভাগকে সুদৃঢ় করার জন্য শাহাবুদ্দীন আহমদ খাঁকে অর্থমন্ত্রী নিযুক্ত করা হয়।

(২) রণথম্ভৌর বিজয় (১৫৬৯ খ্রিঃ) শেরশাহের অমাত্য হাজী খাঁ ৯৬৬ হিজরীতে (১৫৫৮-৫৯ খ্রিস্টাব্দে) রণথম্ভৌরকে রাও সুরজনের হাতে বিক্রি করে দেন। রাও সুরজন সেখানে কয়েকটি প্রাসাদ ও অন্যান্য ঘরবাড়ি নির্মাণ করিয়েছিলেন। সেটা প্রাকৃতিক গিরিদুর্গ ছিল। অনেক জায়গা জুড়ে পাহাড়ের প্রাকৃতিক প্রাচীর। আলাউদ্দীনও রণথম্ভৌর অধিকার করেছিলেন, কিন্তু অনেক সময় লেগেছিল। সেখানে পাশাপাশি দুইটি পাহাড় আছে, একটির নাম রণ, অপরটির নাম থম্ভোর। আসল দুর্গ থম্বৌরের উপর।

১৫৬৮ খ্রিস্টাব্দে আকবর রণথম্ভৌর দখলের জন্য প্রস্তুতি শুরু করেন। বুদির সীমান্ত থেকে কয়েক মাইল উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত রণথম্ভৌর তখন হাড়া চওহানদের হাতে ছিল। বুঁদির পিছনেও হাড়া চওহানদের হাত ছিল। ১৫৬৯ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারিতে রণথম্ভোর অবরোধ শুরু হয়। পাহাড়ের উপর অবস্থিত এই অজেয় দুর্গের প্রারম্ভিক অভিজ্ঞতাতেই বুঝতে পারা যায় যে এই দুর্গ অধিকার চিতৌড়ের মতো সহজসাধ্য হবে না। রণথম্ভোরের রাজা রাও সুরজনসিংহ শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত যুদ্ধ করতে প্রতিজ্ঞবদ্ধ হয়েছিলেন।

কুমার মানসিংহ আলোচনার অজুহাতে দুর্গে প্রবেশ করতে সফল হন । তিনি তার সঙ্গে আকবরকেও পরিচারক হিসেবে নিয়ে যান। কথিত আছে, সুরজনসিংহ বাদশাহকে চিনে ফেলেন। হাড়াদের কিছু বিশেষ সুযোগ-সুবিধে দিয়ে আকবর বিনা যুদ্ধে রণথম্ভৌর হস্তগত করতে সফল হন।

সুযোগ-সুবিধের মধ্যে ছিল— বুদিকে কোনো কন্যাদান করতে হবে না, দীওয়ান-আমেও তাঁদের সশস্ত্র হয়ে যাওয়ার অধিকার থাকবে, তাঁরা রাজধানীর লাল দরজাতেও তাঁদের রণবাদ্য বাজাতে বাজাতে প্রবেশ করতে পারবেন। রণথম্ভৌর অধিকার করার পর রাও সুরজনের ইচ্ছানুসারে আকবর তাঁকে বারাণসীতে থাকার অনুমতি দেন, তারপর দো-হাজারী মনসব দিয়ে সেখানকার শাসক করে দেন।

চুনার দুর্গ রাও সুরজনের হাতেই থাকে । রাও সুরজনের মতো ধার্মিক শাসকের হাতে থেকে বারাণসীর প্রভূত শ্রীবৃদ্ধি ঘটে। তিনি সেখানে চুরাশিটি অট্টালিকা ও পঞ্চাশটি ঘাট নির্মাণ করিয়েছিলেন। রাও সুরজনের দুই পুত্র আকবরের সঙ্গে গুজরাত অভিযানে গিয়ে অত্যন্ত বীরত্বের পরিচয় দেন।

 

 

(৩) কালিঞ্জরের আত্মসমর্পণ (১৫৬৯ খ্রিঃ)— রণথম্ভৌরের পরে আকবর এবার উত্তর ভারতের তৃতীয় অজেয় দুর্গ অধিকার করার সংকল্প করেন। এই কালিঞ্জর জয় করতে গিয়ে শেরশাহ বারুদে ঝলসে প্রাণ হারান। সে-সময় এই দুর্গ বঘেলা রাজা রামচন্দ্রের অধিকারে ছিল, যিনি আকবরের অনুরোধে তানসেনকে তাঁর দরবারে পাঠিয়ে দেন। আকবরের সেনাধ্যক্ষ মজনূ খাঁ কাকশাল কালিঞ্জর ঘিরে ফেলেন।

রামচন্দ্র বুঝতে পারেন, চিতৌড় ও রণথম্ভৌরের যে দশা হয়েছে, কালিঞ্জরের অদৃষ্টেও তাই আছে, সেজন্য অনর্থক রক্তপাতে কি লাভ? তিনি মজনূ খাঁর হাতে দুর্গ সমর্পণ করে দিলেন। আকবর সেই খবর পান ১৫৬৯ খ্রিস্টাব্দে। তিনি রাজা রামচন্দ্রকে প্রয়াগের নিকটে একটি বড় জায়গির প্রদান করেন।

আরও দেখুনঃ

Exit mobile version