টোডরমলের প্রারম্ভিক জীবন, আবুল ফজল রাজনীতি ও রাষ্ট্রবিধিতে অদ্বিতীয় ছিলেন। মানসিংহ শ্রেষ্ঠ সৈনিক ছিলেন। আকবরের নবরত্নের যার মধ্যে এই উভয় গুণাবলীর সমাবেশ ঘটেছিল, তিনি টোডরমল। টোডরের জন্ম অওধে সীতাপুর জেলার লহরপুর গ্রামে, ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম পাদের শেষ দিকে।
টোডরমলের প্রারম্ভিক জীবন | টোডরমল | আকবর
টণ্ডনক্ষত্রী হওয়ার কারণে কত লোক তাদের লাহৌরী- পাঞ্জাবী বানাতে চেয়েছেন, তবে যেমন আচার্য নরেন্দ্রদেব ক্ষত্রী হলেও পাঞ্জাবী নন, তেমনি টোডরমলও পাঞ্জাবী নন, অওধের ছিলেন। বিধবা মাতা অত্যন্ত দারিদ্র্যের মধ্যে এই আশ্চার্য প্রতিভাশালী পুত্রের লালন-পালন করেছিলেন, যেমন করে হোক লেখাপড়াও শিখিয়েছিলেন।
কিন্তু সে-সময় কার বলার ক্ষমতা ছিল যে লহরপুরের এক অনাথ শিশু এক সময় সমগ্র ভারতবর্ষের ভাগ্য-বিধাবা হবেন। টোডরমল যুদ্ধে তাঁর তরোয়ালের তৎপরতা দেখিয়েছেন, তবে তার প্রভাব ওই সময়টুকুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। কিন্তু দেশের শাসনব্যবস্থা ও ভূমি-রাজস্ব-ব্যবস্থার যে নীতি টোডরমল প্রবর্তন করেছিলেন, তার ছাপ সমগ্র মোগল-শাসনকাল, ইংরেজ-শাসনকাল অতিক্রম করে আজও বিদ্যমান ।
প্রথমে তিনি একটা মামুলি দফতরে মুনশী নিযুক্ত হন। তারপর আমির মুজফ্ফর খাঁর দফতরে যোগদান করেন। প্রত্যেক জায়গাতেই তাঁর কাজ দেখে লোকে মুগ্ধ হতো। শেষে আকবরের দফতরে প্রবেশ করেন। যে-কোনো কাজকর্মই তিনি খুব ভেবেচিন্তে করতেন। যা তিনি শিখে নেওয়া জেনে নেওয়া প্রয়োজন বোধ করতেন, তার পিছনেই লেগে থাকতেন।
কাজই কাজ শেখায়। টোডরমল প্রত্যেক কাজই খুব সুন্দরভাবে সমাধা করতে চাইতেন। অন্যান্য সহকর্মীদের চেয়ে দ্রুত সরকারী কাগজপত্র বোঝার জ্ঞান অর্জন করেন। বৃহৎ সাম্রাজ্যের নথি ও কাগজপত্রের কি কোনো ঠাঁই-ঠিকানা ছিল?
অথচ সেই জঙ্গলের ভিতর থেকে কোনো দরকারী জিনিস সঙ্গে সঙ্গে বের করে বাদশাহের সামনে হাজির করা টোডরমলের বাঁ-হাতের খেলা ছিল । তাই বাদশাহের কাছে তাঁর থাকাটা অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল টোডরমল খুব পূজা-অর্চনা করতেন। একবার বাদশাহের সফরের সঙ্গী ছিলেন তিনি ৷ একদিন সৈন্যদলের যাত্রার সময় তাড়াহুড়োতে ঠাকুরের সিংহাসন ফেলে আসেন কিংবা কেউ হয়তো সিংহাসনের বটুয়াটিতে মন্ত্রী-মহোদয়ের মূল্যবান সামগ্রী আছে মনে
করে চুরি করে। তিান পূজা না করে কোনো কাজ করতেন না, মুখে অন্নও তুলতেন না । ফলে আহারাদি ত্যাগ করলেন তিনি । বাদশাহ জানতে পেরে তাকে ডেকে বোঝালেন— “ঠাকুর চুরি হয়েছে, কিন্তু অন্নদাতা ঈশ্বর তো রয়েছেন, তাঁকে তো কেউ চুরি করেনি? স্নান করে তাঁকে স্মরণ করে খাওয়া-দাওয়া করো। কোনো ধর্মেই আত্মহত্যা পুণ্যকর্ম নয়।” টোডরমল তাঁর যুক্তিপূর্ণ কথা মেনে নিয়েছিলেন। একদিকে টোডরমল নিজের ধর্মের ব্যাপারে এত রক্ষণশীল ছিলেন, অথচ অন্যদিকে সময়ের দাবিও উপলব্ধি করতেন।
তিনিই সর্বপ্রথম ব্যক্তি যিনি নিজের ধুতি-মেরজাই ত্যাগ করেন, তার পরিবর্তে বরজু (পায়জামা) পরে তার উপর চোগা ধারণ করেন, পায়ে মোজা পরেন, তুর্কি সেজে ঘোড়া ছোটাতে শুরু করেন। সে-সময় হিন্দুরা জামিনী ভাখা (ফারসি) শিক্ষা পরিহার করে চলতেন। টোডরমল ওইরকম বোকামিকে পাত্তা দেননি। তার মতো ভক্তের দেখাদেখি হিন্দুরা ফারসি শিক্ষা করে বড় বড় পদ লাভ করতে লাগলেন ।
আরও দেখুনঃ