আবুল ফজলের দরবার | আবুল ফজল | আকবর

আবুল ফজলের দরবার, আকবরের সিংহাসনে আরোহণ আঠারো বছর অতিক্রান্ত । এখন তার বয়স ত্রিশ বছর । সাম্রাজ্য সুদৃঢ় হয়েছে, কিন্তু আকবর তাতেই সন্তুষ্ট হওয়ার মানুষ নন। তিনি ভারতের জন্য এক নতুন স্বপ্ন দেখছিলেন. বিশাল, ঐক্যবদ্ধ, শক্তিশালী ভারত। আকবরের দরবারে ফৈজীর যোগদান পাচ বছর হয়ে গেছে।

আবুল ফজলের দরবার | আবুল ফজল | আকবর

 

আবুল ফজলের দরবার | আবুল ফজল | আকবর

 

আবুল ফজলের বয়স তখন কুড়ি বছর, বয়সে নবীন, কিন্তু বিদ্যায় প্রবীণ। তিনি তাঁর চারদিকের জগৎ দেখে অসন্তুষ্ট। যে-সব শাস্ত্র তিনি পাঠ করেছেন, তাতেও তাঁর অসন্তোষ ঘোচেনি। যখন আলিমদের মধ্যে আরও বেশি অন্যায়-অবিচার লক্ষ্য করলেন, তখন তার মন সংসার ছেড়ে বিবাগী হতে চাইল। কখনো ফকির-সন্তদের কাছে যেতে ইচ্ছে করত, কখনো-বা তিব্বতের লামাদের বিষয়ে নানা কথা শুনে তাদের কাছে যাওয়ার জন্য মন ছটফট করত। কখনো মন বলত, পর্তুগালের পাদ্রিদের সঙ্গে সামিল হয়ে যাও। কখনো আবার ভাবতেন, আতা পারসি মোবিদদের কাছে চলে যাব।

আবুল ফজলের যোগ্যতার খবর আগেই পেয়েছিলেন আকবর । যখন দরবারে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব এল, তখন প্রথম প্রথম তাঁর যেতে ইচ্ছে করছিল না । পিতা বোঝালেন— আকবর অন্য রকমের মানুষ । তাঁর কাছে গেলে তোমার সংশয় দূর হবে। যদি পিতা অন্য মোল্লাদের মতো সঙ্কীর্ণমনা হতেন, তাহলে সম্ভবত আবুল ফজলের উপর তাঁর কথার কোনো প্রভাব পড়ত না। কিন্তু তিনি পিতার চিন্তা-ভাবনা জানতেন, তাঁর পরামর্শ মনঃপূত হলো।

বাদশাহ সে-সময় আগরায় এসেছিলেন। তাঁকে কুর্নিশ (বন্দনা) করার সৌভাগ্য হলো আবুল ফজলের। তখনকার মতো ওই পর্যন্তই হয়ে থাকল। বাংলায় বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে আকবর সেখানে যাত্রা করেন। ফৈজী বাদশাহের ছায়া। তিনি পত্র লিখে জানাতেন— বাদশাহ তোর কথা স্মরণ করেন। পাটনা জিতে আজমের এলেন তো ফের জানতে পারলেন, বাদশাহ তাঁর কথা মনে রেখেছেন। যখন বাদশাহ ফতেহপুর সিক্রীতে এলেন, তখন পিতার অনুমতি নিয়ে আবুল ফজল ভ্রাতার বাসায় গিয়ে উঠলেন। পরদিন জামা মসজিদে বাদশাহ এলেন।

আবুল ফজল দূর থেকে কুর্নিশ করলেন। চোখে পড়তেই বাদশাহ তাঁকে নাম ধরে নিজের কাছে ডাকলেন। আবুল ফজল ভাবলেন, হয়তো অন্য কোনো আবুল ফজল হবে। কিন্তু যখন বুঝলেন যে তাঁরই ভাগ্য ফিরেছে, তখন সেখানে দৌড়ে গেলেন । সেই সংসার ও ধর্মের মানুষের ভিড়েও বাদশাহ বেশ কিছুক্ষণ কথা বললেন তাঁর সঙ্গে।

আবুল ফজল কুরানের সূরা ফাতিহার ভাষ্য লিখে রেখেছিলেন, সেটা উপহার দিলেন বাদশাহকে। আকবর তাঁর মোসাহেবদের এই যুবকটি সম্পর্কে এমন এমন কথা বললেন যা তার নিজেরও জানা ছিল না। তখন থেকেই আবুল ফজল আকবরের দরবারে থেকে গেলেন, কিন্তু দু’টি বছর তার মনের উচাটন দূর হয়নি।

মোল্লা বদায়ূনী তখনকার বিষয়ে লিখেছেন— “৯৮২ হিজরীতে (১৫৭৪-৭৫ খ্রিঃ) বাদশাহ আজমের থেকে ফিরে ফতেহপুরে ছিলেন । খাক্বাহ্ (সলীম চিন্তার আখড়া)- এর পাশে উপাসনা-মন্দির নির্মাণ করিয়েছিলেন, তাতে চারটি কক্ষ ছিল। সেই সময় শেখ মুবারক নাগৌরীর উপযুক্ত পুত্র আবুল ফজল, অনেকে যাকে আল্লামী বলে লিখে থাকেন, বাদশাহের কর্মচারী নিযুক্ত হন। তিনি জ্ঞান-বুদ্ধিতে জগতে হৈ-চৈ ফেলে দিয়েছিলেন। যে তাঁর বিরুদ্ধতা করেছেন, তাঁকেই শেষ করেছেন। সমস্ত ধর্মমতের বিরোধিতা করাটাই যেন তিনি নিজের কর্তব্য বলে মনে করেন, সেই কাজের জন্য কোমর বেঁধে নেমেছেন তিনি ।”

মোল্লা বদায়ূনী, যে পর্যন্ত প্রাচীন গোঁড়াপন্থীদের মূলোচ্ছেদ করার প্রশ্ন ছিল, ততদূর অবধি আবুল ফজলের সঙ্গে ছিলেন। কিন্তু নিজের মোল্লাপনার প্রতিও তাঁর দুর্বলতা ছিল। আবার লিখেছেন— “এখন শেখ মুবারকের দুই পুত্রের আধিপত্য চলছে।

শেখ আবুল ফজল বাদশাহের পৃষ্ঠপোষকতা, তাঁর সেবা করা, নিজের বাস্তব- বুদ্ধি, অধর্মাচরণ এবং সীমাহীন খোশামোদে এমন ক্ষমতা লাভ করেছেন যে যে-দল চুকলি খেয়েছে, অনুচিত চেষ্টা-চরিত্র করেছে, তিনি তাদের জঘন্যভাবে দুর্নাম রটিয়েছেন। পুরনো গম্বুজের মূলোৎপাটন করে ফেলে দিয়েছেন, বলতে গেলে, সমস্ত ঈশ্বর-ভক্ত, সন্ত, আলিম, অনাথ, অক্ষমের বৃত্তি-অনুদান খারিজ করে দেওয়ার মূল কারণ তিনিই।” আবুল ফজল সত্য সত্যই আগুন জ্বালিয়ে সমস্ত জঞ্জাল ভস্মীভূত করে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন, তাই তিনি মুখে এই চৌপদী আওড়াতেন—

আতিশ ব-দো দস্তে-খওয়েশ দর্ খিমেনে-খেশ ।

চুঁ খুজদঃয়ম্ চি নালম্ অজ্ দুশমনে-শ্বেশ ।

কস্ দুশমনে-মন নেত্ মনম্ দুশমনে-স্পেশ ।

অয়্ ওয়ায়ে, মন্ ওয়া দস্তে-মন্ ওয়া দামনে-স্বেশ ।

 

(আমি যখন দু’হাতে নিজের শস্যগোলায় আগুন দিয়েছি, তখন আমার বন্ধু অথবা শত্রুকে নিয়ে কাঁদতে যাব কেন? কেউ আমার শত্রু নয়, আমি নিজেই আমার শত্রু। ওহো, আমি, আমার হাত আর এই আমার বস্ত্রাঞ্চল ।) মোল্লারা প্রাচীনকালের বড় বড় আলিম ও ধর্মশাস্ত্রবিদের বক্তব্য পেশ করতেন। বিতর্ক হতো। আবুল ফজল বলতেন— অমুক ময়রা, অমুক মুচি, অমুক চামারের বক্তব্যও পেশ করছেন না কেন? তারা কোনো বিখ্যাত না ও বাক্যবাগীশের মধ্যে পড়ে না। যে-কথা যুক্তি-বুদ্ধি দিয়ে বোঝানো যায় না, তাদের মনে সে-কথার কোনো ইজ্জত নেই । আকবরও তাঁর মতামত সমর্থন করতেন।

আবুল ফজল বাণীর বরপুত্র ছিলেন। এমন বাণী ও লেখনীর খুব প্রয়োজন ছিল আকবরের। তিনি লিপি-বিভাগে আবুল ফজলকে কাজ দিয়েছিলেন এবং সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অভিযানের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করারও ভার দিয়েছিলেন তাঁর উপর। যে-কোনো কাজই তিনি এমন সুচারুরূপে সম্পন্ন করতেন যে তাঁকে ছাড়া কোনো কাজই বাদশাহের পছন্দ হতো না।

পেটে ব্যথা হলো, তো হাকিমও আবুল ফজলের মতামত নিয়ে ওষুধপত্র দিতেন। ঘা-ফোড়ায় মলম লাগাতে হবে, তার ব্যবস্থাপত্রেও আবুল ফজলের পরামর্শ জুড়ে দেওয়া হতো। তখন আর কুরানের ভাষ্যকার হওয়ার প্রয়োজন ছিল না আবুল ফজলের। আজাদের কথায়— “মোল্লাগিরির সঙ্কীর্ণ গলিতে ঘোড়া ছুটিয়ে তিনি মনসবদার আমিরদের ময়দানে গিয়ে ঝাণ্ডা পুঁতলেন।”

 

আবুল ফজলের দরবার | আবুল ফজল | আকবর

 

দরবারে আসার বারো বছর পরে ৯৯৩ হিজরীতে (১৫৮৫-৮৬ খ্রিঃ) আবুল ফজলের অনেক উন্নতি ঘটে। সেই সময় তিনি একহাজারী মনসব লাভ করেন। চেঙ্গিস খান তাঁর শাসনব্যবস্থার বিভিন্ন পদমর্যাদাকে দশ, শত, হাজার ইত্যাদি ক্রমানুসারে ভাগ করেছিলেন। বাবর ও তাঁর পূর্বপুরুষ তৈমূর লঙের হৃদয়ে পয়গম্বর মুহম্মদের চেয়ে বিধর্মী চেঙ্গিস খানের মর্যাদা কম ছিল না, এবং তাঁরা বহু ব্যাপারে চেঙ্গিস খানের প্রথা অনুসরণ করতেন।

চেঙ্গিস খানের দপ্তরের কাজ প্রথমে সেখানকার ভিক্ষুরা সামলাতেন । মঙ্গোল ভাষায় ভিক্ষুকে বখ্শী বলা হয়। পরে মুনশীদের (লেখকদের) নামই বখ্শী হয়ে যায়। এই পদটিও বাবরের সঙ্গে ভারতে এসেছিল। বর্তমানে কত হিন্দু-মুসলমান নিজেদের নামের সঙ্গে বখ্শী জুড়ে গৌরব অনুভব করেন। একইভাবে একহাজারী, দু’হাজারী, পাঁচহাজারী পদ (মনসব)-ও বাবরের মধ্য-এশিয়া থেকে ভারতে এসেছিল ।

১৫৮৮-৮৯ খ্রিস্টাব্দে (৯৯৭ হিঃ) আবুল- ফজল বাদশাহের সঙ্গে লাহৌরে ছিলেন। তখন তাঁর বয়স উনচল্লিশ বছর। সেই বছরেই তাঁর মাতার মৃত্যু হয় । নিজেদের মাতা- পিতার প্রতি দুই ভ্রাতারই অত্যন্ত ভক্তি-শ্রদ্ধা ছিল। মাতার মৃত্যুর পর কোনো এক অজ্ঞাত কবির এই কবিতা তিনি বারবার বলতেন—

খুঁ কি আজ-মেরে-তূ শুদ্ শীর ওয়া ব-তিফলী খুর্দম্; 

বাজ আঁ খুন শুদ্ ওয়া আজ দীদ্ বরঁ মী আয়াদ্ 

 

(তোমার দয়ায় রক্ত রূপান্তরিত হয়েছিল দুধে, আমি সেই দুধ শৈশবে পান করেছিলাম। সেই দুধ আবার রক্তে পরিণত হয়েছে, আমার চোখ থেকে তা ঝরে পড়ছে।) মাতার মৃত্যুর খবর শুনে আবুল ফজল অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন। বলতেন— চুঁ মাদরে-মন্ ব-জেরে-খাকঃ । গর্ খাক বসর কুনম্ চে বাক’স্। (যখন আমার মা মাটির নিচে রয়েছেন, তখন আমি সেই মাটি মাথায় রাখব, ক্ষতি কি?

আকবর তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন— “যদি পৃথিবীর সমস্ত মানুষ অমর হতো এবং একজন ব্যতীত কাউকেই মৃত্যুপথের যাত্রী হতে না হতো, তবুও তার বন্ধুদের জন্য আত্মসংবরণ করা ছাড়া উপায় থাকত না। তাহলে এ পান্থনিবাসে যখন কারও বেশি সময় থাকার কথা নয়, তখন অধৈর্য হয়ে লাভ কি?”

 

আবুল ফজলের দরবার | আবুল ফজল | আকবর

 

আবুল -ফজলের একটিই পুত্র ছিলেন আব্দুর রহমান। পিতার মতো সমস্ত যোগ্যতা তো তাঁর ছিলই, সেই সঙ্গে কুশলী তলোয়ারবাজও ছিলেন। মাতার মৃত্যুর দু’বছর পরে আবুল- ফজলের পৌত্র জন্মগ্রহণ করে, আকবর তার নাম রাখেন পশোতন। সেটা আরবি নামও নয়, ইসলামীও নয়। এ থেকেই বোঝা যায় যে সে সময় কিরকম হাওয়া চলছিল। যদি আকবর ও আবুল- ফজলের পতাকা সম্মুখে বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আর দুই প্রজন্ম পাওয়া যেত, তাহলে ভারতে হিন্দু-মুসলমান সমস্যা থাকত না, পাকিস্তানও তৈরি হতো না।

১৫৯১-৯২ খ্রিস্টাব্দে (১০০০ হিজরী) আবুল -ফজল দু’ হাজারী মনসব পান এবং তার চার বছর পরে আড়াই হাজারী। আজাদ লিখেছেন— “তিনি আকবরের পারিষদ, উপদেষ্টা, বিশ্বাসভাজন, মীর-মুশী (প্রধান সচিব), ওয়াকিয়া-নিগার (ইতিহাস- লেখক), আইন-প্রণেতা, দীওয়ান (শাসন-বিভাগ)-অধ্যক্ষই ছিলেন না, তিনি ছিলেন বাদশাহের মুখের ভাষা, না-না, তাঁর বুদ্ধির চাবিকাঠি। বলুন, আলেকজান্ডারের সামনে অ্যারিস্টটল। লোকে মুখে যাই বলুক, যদি প্রশ্ন করেন, ওই সব পদের যোগ্যতা তাঁর ছিল, কি ছিল না; তাহলে দৈববাণী শুনতে পাবেন— ওই সব পদের চেয়ে অনেক উঁচু পদের যোগ্য ছিলেন তিনি।”

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment