কবিরাজ ফৈজীর অবদান

কবিরাজ ফৈজীর অবদান – নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “আকবর” বিষয়ের “হেমচন্দ্ৰ হেমু” বিভাগের একটি পাঠ।

কবিরাজ ফৈজীর অবদান

 

কবিরাজ ফৈজীর অবদান | কবিরাজ ফৈজী | আকবর

 

১. দীওয়ান— অকারান্ত ক্রমে সংকলিত ফৈজীর কবিতা-সংগ্রহ (দীওয়ান) তৎকালেই সম্পাদিত হয়েছিল। এতে নয় হাজার বায়েত্ (পঙ্ক্তি) অর্থাৎ সাড়ে চার হাজার শ্লোক রয়েছে। শামশুল-উমা আজাদের মতো পণ্ডিত লিখেছেন যে তাঁর গজলগুলি সুন্দর মার্জিত ফারসি ভাষায় রচিত। তিনি যথাসম্ভব অতিশয়োক্তি বর্জন ও ভাষার সৌকর্য রক্ষায় যত্নবান হয়েছেন, যাতে তার পূর্ণ দখল ছিল।…

মনের মধ্যে আবেগ তৈরি হয়, কিন্তু কথা কখনও তার সীমা অতিক্রম করতে পারে না। একটি বিন্দুও তিনি ব্যর্থ- প্রয়োগ করেননি। আমি অবশ্যই বলব, এটা সাদীর রচনাশৈলী, কিন্তু সাদী প্রেম ও সৌন্দর্যে মগ্ন, ফৈজী দর্শন, মনোবিজ্ঞানের বাস্তবতা ও অন্তরঙ্গতায় বিলীন। আরবি ভাষারও পক্তি রয়েছে, কোথাও কোথাও এক-আধটা বাক্য জুড়ে দেওয়া হয়েছে, তাতে আশ্চর্য আনন্দের অনুভূতি হয় ।

২. কসীদে— ফৈজী রাজসভার কবি ছিলেন, সঙ্গত কারণেই তিনি প্রশস্তি (কসীদা) রচনা করতে বাধ্য হয়েছেন। আজাদের মতে, “তিনি যা কিছু বলেছেন, অত্যন্ত সংযতভাবেই উচ্চারণ করেছেন।” ফৈজীর গজল ও কসীদার সংখ্যা কুড়ি হাজার। আকবর তাঁর কবিতা এত পছন্দ করতেন, তার কারণ, তার প্রসাদ গুণ, সাবলীলতা, যা সহজেই বোধগম্য হয়। দ্বিতীয়ত তিনি তাঁর মালিকের মন-মেজাজ বুঝতেন এবং দেশ-কালের উপযোগী রচনা করতেন। “হৃদয়ে সাড়া দিত, অমনি মনোরঞ্জক কথা মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসত। আকবর শুনে খুশি হতেন। সারা দরবার উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠত ।”

 

কবিরাজ ফৈজীর অবদান | কবিরাজ ফৈজী | আকবর

 

৩. নল-দমন (পঞ্চ-গঞ্জ খম্‌সা)— ১৫৮৫ খ্রিস্টাব্দে (৯৯৩ হিজরীতে) আকবর বলেছিলেন— নিজামী পঞ্চ-গঞ্জে অপূর্ব শিল্পনৈপুণ্য দেখাবার চেষ্টা করেছেন, তুমিও করো। সেজন্য পাঁচখানি গ্রন্থও নির্বাচন করা হয়, তা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, ফৈজী কেবল ‘নল-দমন’ (নল-দময়ন্তী)-ই সম্পূর্ণ করতে পেরেছিলেন। ‘সুলেমান-ওয়া- বিলকয়েস-এর কয়েকটি শ্লোক পাওয়া যায়, একই কথা ‘আকবরনামা’ সম্বন্ধেও।

বাকিগুলিতে তিনি হাত দিতেই পারেননি। লেখার কাজ এগোচ্ছে না দেখে ১৫৯৩-৯৪ খ্রিস্টাব্দে (১০০২ হিজরীতে) লাহৌরে থাকার সময় বাদশাহ তাঁকে পুনরায় তাগাদা দিয়ে বলেন— আগে ‘নল-দমন’ সম্পূর্ণ করো। ফৈজী চার মাসে সেটা সমাপ্ত করেন।

শামতল-উমা আজাদ মনে করেন ফৈজী এর আখ্যান কালিদাসের কোনো রচনা থেকে হয়তো নিয়ে থাকবেন, কিন্তু কালিদাস এ বিষয়ে কোনো কাব্য রচনা করেননি, সে-কথা আমরা জানি। ফৈজী মহাভারত দেখেছিলেন, সুতরাং ‘নলোপাখ্যান’ সম্পর্কে তিনি পরিচিত ছিলেন।

ত্রিবিক্রম সর্বপ্রথম এই উপাখ্যানটি ‘নলচম্পূ’-তে লিখেছিলেন। ত্রিবিক্রমের পরে কান্যকুজের রাজা জয়চন্দ্রের সভাসদ তথা শ্রেষ্ঠ কবি শ্রীহষ এই উপাখ্যান নিয়ে নৈষধ” রচনা করেন যা সংস্কৃতের একটি মহান কাব্য বলে শ্রীহর্ষ থেকে তিন শত বছর পরে ফৈজী ফারসিতে ‘নল-দমন’ লেখেন। এই কাব্য পাঠ করলে মনে হয় না ফৈজী ত্রিবিক্রম ও শ্রীহর্ষের কাব্যের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। স্বীকৃত। মোল্লা বদায়ূনী ‘নল-দমন” সম্পর্কে লিখেছেন— “সেই সময় হুজুর মালিকুশ-শু’ অরা-কে বললেন— পঞ্চ-গঞ্জ লেখো।

মাস পাঁচেকের মধ্যে প্রেমিক-প্রেমিকা বিষয়ক ‘নল-দমন’ লেখা শেষ করো। কাহিনীটি ভারতবাসীদের মধ্যে বিখ্যাত। চার হাজার দুই শত শ্লোকের কিছু বেশি। তিনি কিছু আশরফির সঙ্গে পাণ্ডুলিপি বাদশাহকে উপহার দিলেন। বাদশাহের খুব পছন্দ হয়।

আদেশ হলো, ভালো লিপিকর লিখবে এবং চিত্রশিল্পী চিত্রাঙ্কন করবে। রাতে নকীব খাঁ বাদশাহকে পুস্তকাদি পাঠ করে শোনাতেন, তাঁকেও এ কাজে যুক্ত করে দেওয়া হলো।…এ কথা সত্য যে বিগত তিন শত বছরে ‘খুসরো-শিরির পরে এই মনওয়ি (প্রেমোপাখ্যান) সম্ভবত ভারতে এই প্রথম কেউ লিখলেন।” তা সত্ত্বেও মোল্লা বদায়ূনী কি করে ক্ষমা করবেন যদি ফৈজীর মুখে এ কথা শোনেন—

 

কবিরাজ ফৈজীর অবদান | কবিরাজ ফৈজী | আকবর

 

শুক্রে-খুদা কি ইকে-বুতানা’স্ত্ রহবরম্ । দর মিল্লতে-বরহমন ওয়া দরদীনে আজুরম্

(খোদাকে ধন্যবাদ যে মূর্তিদের প্রতি ভালোবাসা আমার পথপ্রদর্শক। আমি

জাতিতে ব্রাহ্মণ এবং ধর্মে পারসি’ ।) মোল্লা বদায়ূনীর মতোই কবি নিশাঈ ফৈজীর রচনায় প্রক্ষেপণ করে লিখেছেন—

“শুক্রে-খুদা কি পৈরূয়ে দীন পয়গম্বরম্ ।

হুব্বে রসূল ওয়া আলের্ সুলে হরবরম্ ।”

 

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment