মোল্লা বদায়নী দরবার | মোল্লা বদায়নী | আকবর

মোল্লা বদায়নী দরবার, মার্চ (১৫৭৪ খ্রিঃ) মাসে বদানী আগরায় এসে পৌঁছান। জামাল খাঁ কুচীর সঙ্গে তাঁর দেখা-সাক্ষাৎ হয়। তিনি আকবরের বিশিষ্ট দরবারীদের অন্যতম। যদিও মাত্র পাঁচ- শতকী মনসবদার ছিলেন, কিন্তু বাদশাহের নিকটে পৌছানোর এখতিয়ার ছিল তাঁর। তিনি দানশীল ছিলেন, খেতে ও খাওয়াতে ভালোবাসতেন। পরের বছর তাঁর মৃত্যু হয় । “ইহলোকে সুনাম ছিল, পরলোকে গেলেন পুণ্য সঙ্গে নিয়ে।”

মোল্লা বদায়নী দরবার | মোল্লা বদায়নী | আকবর

 

মোল্লা বদায়নী দরবার | মোল্লা বদায়নী | আকবর

 

জামাল খাঁ মোল্লার পিছনে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়লেন, তাঁর পাণ্ডিত্যপূর্ণ ভাষণ শুনলেন, খুব খুশি হলেন। তিনি তাঁকে আকবরের কাছে নিয়ে গিয়ে বললেন— “হুজুরের জন্য নামাজের ইমাম নিয়ে এলাম।” মোল্লা তাঁর “মুন্তখিবুত্-তওয়ারিখ” গ্রন্থে স্বয়ং লিখেছেন— “তদবিরের পায়ে তকদিরের শিকল পড়ল।

৯৮১ হিজরীতে (১৫৭৪ খ্রিস্টাব্দে) হুসেন খাঁর সঙ্গ ত্যাগ করে আগরায় এলাম। জামাল খাঁ কুর্চী ও হাকিম অয়নুল্-মুকের সাহায্যে রাজানুগ্রহ লাভ হলো। তখনকার দিনে শাস্ত্র-সভার খুব চল হয়েছিল। পৌঁছতেই সদস্যদের মধ্যে স্থান হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত এমন হলো যে, যে-আলিম কাউকে পাত্তা দিতেন না, তাঁর সঙ্গেও বাদশাহ লড়িয়ে দিলেন। খোদার মেহেরবানি, বুদ্ধির ক্ষমতা, প্রতিভার তেজ এবং মনের জোরে অনেককেই পরাজিত করলাম।

প্রথম অনুগ্রহ দান করেই বাদশাহ জানালেন, এই বদায়ূনী হাজী ইব্রাহিম সরহিন্দীর সঙ্গে তর্কে জয়লাভ করুক। তিনি চাইছিলেন, যেভাবেই হোক, তাঁর যেন পরাজয় হয়। আমি তাঁকেও ভালোরকম পর্যুদস্ত করলাম। বাদশাহ খুব খুশি হলেন। সদরুস্-সদর শেখ আব্দুন্ নবী মনে মনে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন, তাঁকে না জানিয়ে কেন এ লোকটা আচমকা দরবারে ঢুকে পড়ল। এখন আমার শাস্ত্রানুশীলন- সভায় ভিড়তে দেখলেই তাঁর সেই প্রবাদ-বাক্যের কথা স্মরণ হয়— একে তো সাপে কেটেছে, তার উপর খেয়েছে আফিম। যাই হোক, শেষে ধীরে ধীরে সদরের ক্রোধ স্নেহে পরিবর্তিত । হয়েছিল।”

মোল্লা বদায়ূনী দরবারে নবাগত। চারদিক থেকে প্রশংসা শুনে তাঁর দেমাক আকাশে চড়েছে। তাঁর খেয়াল ছিল না, আমিও ওইরকম এক মোল্লা, যেমন ওঁরা, যাঁদের আমি পরাস্ত করার জন্য উঠে-পড়ে লেগেছি। মোল্লা তখন আবুল ফজলের ভীষণ গুণগ্রাহী, সেই সঙ্গে আকবরের গুণগ্রাহিতায় মুগ্ধ। মোল্লাদের মধ্যে তর্কযুদ্ধ বাধিয়ে দেওয়ার শখ তো আকবরের ছিলই, এখন তার জন্য বদায়ূনীকে সঙ্গে রাখেন।

এই সময় পাটনার দিকে বিদ্রোহ দেখা দেয়। শেরশাহের বংশের মাধ্যমে পাঠানরা দেশ-শাসনের স্বাদ পেয়েছিল। তারা সামান্য সুযোগ পেলেই বিদ্রোহের ঝাণ্ডা হাতে তুলে নেয়। বাদশাহের সেনাপতি মুনায়ম পাঠানদের সঙ্গে সংগ্রামে লিপ্ত ছিলেন। কিন্তু পরিস্থিতির এতই অবনতি হয় যে স্বয়ং আকবরের সেখানে যাওয়ার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। আগরা থেকে সেনাবাহিনীকে স্থলপথে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পরে সমস্ত বেগম, করেন। মোল্লা লিখেছেন— “অজস্র নৌকায় নদীর জল চোখে পড়ে না। নানা রকমের নৌকা, তাতে আশমানী রঙের পাল খাটানো।

কোনো নৌকার নাম ‘নিহঙ্গসরে, কোনোটার নাম ‘শেরসর’, ইত্যাদি ইত্যাদি। রঙ-বেরঙের পতাকা উড়ছে। নদীর উপর কোলাহল, প্রবল হাওয়া, জলের ছলাৎ-ছলাৎ শব্দ। নৌবহরের নৌকা চলেছে, মাল্লারা নিজের নিজের ভাষায় গান জুড়েছে। বিচিত্র দৃশ্য, মনে হয়, খুব শীঘ্রই বাতাসে পাখি ও জলে মাছ নাচানাচি করবে।

যাত্রার কি বর্ণনা দেবো? যেখানে খুশি, নেমে পড়ছেন মৃগয়ার জন্য । যখন খুশি, উঠে পড়ছেন যাওয়ার জন্য। কোথাও বা রাতে নোঙর ফেলা হচ্ছে, সেখানেই শাস্ত্রানুশীলন এবং শের ও শায়েরীর আসর বসে যাচ্ছে। সঙ্গে ফৈজীও রয়েছে। নৌবহরের নৌকা সাধারণ যাতায়াতের নৌকা নয় ।

এই নৌবহরে তোপখানা, হাতিয়ার-ঘর, কোষাগার, নাকাড়াখানা, তোশাখানা, ফরাশখানা, বাবর্চিখানা, ঘোড়ার আস্তাবল— সমস্ত রয়েছে। হাতির জন্য বড় বড় নৌকা। একটায় সওয়ার হয়েছে দুই হস্তিনীর সঙ্গে প্রসিদ্ধ হাতি বালসুন্দর। আর একটায় রয়েছে সমনপাল, সঙ্গে দুই হস্তিনী ।

শিবির ও সৈন্যঘাঁটি যেভাবে সাজানো হয়, নৌবহরও তেমনি। তাতে আলাদা আলাদা কামরা, কামরাগুলোতে রয়েছে বেদি, সুন্দর সুন্দর তাক । নৌকাগুলো দোতলা- তেতলা । উপরে-নিচে ওঠা-নাম করতে হয় সিঁড়ি দিয়ে। হাওয়া-বাতাসের জন্য রয়েছে জানালা, আলোর জন্য রয়েছে লণ্ঠন। তুর্কি, চীনা, বিলেতি মখমল ও বনাতের পরদা এবং অত্যন্ত দামী গালচেতে সুসজ্জিত করা হয়েছে। নৌবহরের মধ্যিখানে চলেছে বাদশাহের জাঁকজমকপূর্ণ নৌকা ।”

দুটি বছর খোশ-মেজাজেই কেটেছিল। তারপর, ৯৮৩ হিজরীতে (১৫৭৫-৭৬ খ্রিস্টাব্দে) পৌছতে না-পৌছতেই দরবারের কীর্তি-কলাপ মোল্লা বদায়ূনীর অপছন্দ হতে থাকে। অমনি তাঁর লেখনীর গতিভঙ্গি বদলায়। স্পষ্ট মনে হয়, লেখনী থেকে অক্ষর এবং চোখ থেকে অশ্রু সমানে বইছে।

বাদশাহের সাতজন ইমাম ছিলেন। সপ্তাহের এক-একদিন এক-একজন ইমাম পালা করে নামাজ পড়াতেন। মোল্লা বদায়ূনী সঙ্গীতেও আসক্ত ছিলেন। বড় মধুর কণ্ঠস্বর ছিল তাঁর। তাঁর মুখে ফারসি শের কিংবা আরবি আয় বড় মধুর শোনাত। লিখেছেন— “মধুর কণ্ঠের জন্য যেমন তোতাপাখিকে খাঁচায় পুরে দেয়া হয়, তেমনি আমাকে ওই সবার (ইমামতির) মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে বুধবারের ইমামতির কাজ দেওয়া হল।” হাজিরা দেখার কাজের ভার ছিল খোজা (হিজড়া) দৌলত নাজিরের উপর। খুব কড়া মেজাজের লোক ছিল, লোকজনকে বিস্তর জ্বালাতন করত। এভাবেই মোল্লা সাহেব “ইমাম আকবরশাহ” হন।

বাদশাহ এ বছরই তাঁকে বীসতী (বিংশতিক) মনসব ও কিছু পুরস্কার দেন। আবুল ফজলও সেই মনসব পেয়েছিলেন। মনসবদারদের হাজারী, দু-হাজারী, পাঁচ হাজারী মনসব দেওয়া হতো। কিন্তু তারা না মনসব অনুসারে ঘোড়া রাখত, না লোকজন, সরকারী অর্থ আত্মসাৎ করত তারা। এসব নিয়ন্ত্রণের জন্য নতুন ফরমান জারি করা হলো এবং ঘোড়ার গায়ে ছাপ (দাগ) মারা শুরু হলো। সেজন্য এই নিয়মকে ‘দাগানো ও বলা হয়। মোল্লা মনসব পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাকে ‘দাগানো’র জন্য ঘোড়া হাজির করতে বলা হলো।

আবুল ফজল ও মোল্লা আব্দুল কাদির একই চাটুর দুই রুটি। আবুল ফজল দ্রুত হুকুম অনুসারে কাজ করলেন এবং এমন ভালোভাবে করলেন যে তিনি দু-হাজারী মনসবদার ও ওয়াজির হয়ে গেলেন, তাঁর বাৎসরিক আয় চোদ্দ হাজার। মোল্লা নিজের সম্বন্ধে লিখেছেন— “অভিজ্ঞতা না থাকায় এবং আত্মভোলা হওয়ার জন্য আমি তো আমার কম্বলখানাই সামলাতে পারিনে।

তখন ভাবতাম, সন্তোষ-লাভই বড় সম্পদ। একটু জায়গির আছে, বাদশাহ-ও কিছু পুরস্কার- টুরস্কার দেবেন, তাই যথেষ্ট।” দু’বছর তিনি দরবারে রয়েছেন। ৯৮৩ হিজরীতে (১৫৭৫-৭৬ খ্রিস্টাব্দে) ছুটি নিয়ে কিছুদিন স্বাধীনভাবে কাটানোর ইচ্ছে হলো । বাদশাহ ছুটি দেওয়ার সময় একটা ঘোড়া ও কিছু টাকা, সেই সঙ্গে এক হাজার বিঘে জমিও দিয়ে বললেন, সামরিক বিভাগ থেকে তাঁর নাম কেটে দিচ্ছেন ।

পরের বছর (১৫৭৬-৭৭ খ্রিঃ) আকবর জিয়ারতের উদ্দেশ্যে আজমেরে ছিলেন । মোল্লা সাহেবও সেখানে এসে উপস্থিত হলেন। রানা প্রতাপের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা হয়েছে। রাজা মানসিংহের নেতৃত্বে বিশাল পল্টন কুম্ভলনেরের দিকে যাচ্ছে। আজমেরে তিন ক্রোশ ব্যাপী আমিরদের তাঁবু খাটানো হয়েছে। মোল্লাও গাজীদের তালিকায় নাম তোলার জন্য গেছেন। সেই সময় মনের মধ্যে গাজী (ধর্মবীর) হওয়ার খুব শখ হয়েছিল তাঁর।

ফিরে এসে সোজা আব্দুন্ নবীর (সদর, শেখুল্-ইসলাম) কাছে গিয়ে বললেন : আপনি হুজুরকে বলে ছুটি পাইয়ে দিয়ে আমাকে এই যুদ্ধে পাঠিয়ে দিন। কিন্তু সদরকে দিয়ে কাজ হলো না। বাদশাহের পুস্তক-পাঠক ছিলেন নকীব খাঁ, তিনি তো তাঁর সহপাঠীই ছিলেন, তাঁকে বললেন। তিনি জানালেন— “সেনাপতি হিন্দু (মানসিংহ) না হলে আমিই তো সবার আগে যুদ্ধে নাম লেখাতাম।” মোল্লা তাঁকে বোঝালেন— “আমি আমার সেনাপতি হজরতের বান্দাদের জানি, মানসিংহ ইত্যাদি নিয়ে মাথা ঘামাব কেন।

 

মোল্লা বদায়নী দরবার | মোল্লা বদায়নী | আকবর

 

উদ্দেশ্য ঠিক থাকা চাই।” আকবর একটা উঁচু চবুতরায় পা ঝুলিয়ে মির্জা মুবারকের দিকে মুখ ফিরিয়ে বসে ছিলেন। নকীব খাঁ মোল্লা বদায়ূনীকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে প্রার্থনা জানালেন। বাদশাহ তো প্রথমেই জানিয়ে দিলেন— “ওঁর জায়গা তো ধর্মকর্মে, উনি যাবেন কি করে?” নকীব খাঁ বললেন— “গাজী হওয়ার ইচ্ছে।” মোল্লাকে ডেকে আকবর জিজ্ঞাসা করলেন— “খুব ইচ্ছে করছে?”- “খুব।”— “কারণ কি?” – “এভাবেই কালো দাড়ি লাল করতে চাই।”

কারে তু ব-খাতির’স্ত্ খওয়াহম্ ।

 ইয়া সুর্খ খুনম্ রূয়ে জ-তু ইয়া গৰ্দন ।

(তোমার কাজের কথা রয়েছে আমার মনে। সে-কাজ করতে চাই, তোমার জন্য লাল করব মুখমণ্ডল, নয় তো গ্রীবা।) বাদশাহ বললেন— “ঈশ্বর করুন, জয়লাভের খবর নিয়ে এসো।” তিনি পা উপরে টেনে নিলেন। দীওয়ানখানা থেকে যখন বেরুচ্ছি, তিনি আবার “আমি (মোল্লা) চবুতরার নিচে হাত বাড়ালাম তাঁর পা স্পর্শ করার জন্য, অমনি ডাকলেন। একমুঠো আশরফি দিয়ে বললেন— ‘খোদা হাফিজ।’ গুনে দেখি, পঁয়ষট্টি আশরফি ।”

মোল্লা তরোয়াল চালাতে গিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর কলম চলত বেশি সাফল্যের সঙ্গে। লিখেছেন— “জয় হলো। রানা পালিয়ে গেছেন। আমিরেরা বসলেন পরামর্শ করতে । এলাকার বন্দোবস্ত শুরু হলো। রামপ্রসাদ নামক একটা বড় লড়াকু হাতি ছিল রানার। বাদশাহ কয়েকবার সেটা চেয়েছিলেন, কিন্তু রানা দেননি। লুঠের মালের মধ্যে সেটাও ছিল। আমিরেরা পরামর্শ করে ঠিক করলেন, বিজয়পত্রের সঙ্গে সেটাকেও হুজুরের কাছে পাঠানো উচিত। আসিফ খাঁ আমার নাম করলেন— “উনি কেবল পুণ্যলাভের জন্য এসেছেন, ওঁর সঙ্গেই ওটাকে পাঠিয়ে দেওয়া হোক।’

“মানসিংহ বললেন— ‘এখন তো অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ রয়েছে। এখানে এই যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাদের সামনে ইমামের কাজ করবেন কে?’ “আমি বললাম— ‘এখানে ইমামের কাজ করার লোক আরও অনেক আছেন। আমি এবার চললাম। এখন আমার কাজ হজরতের কর্মচারীদের সামনে ইমামের কর্তব্য পালন।’

“মানসিংহ এ-কথায় খুশি হলেন। সতর্কতার জন্য তিন শত সওয়ারি হাতি দিলেন সঙ্গে। তারপর সুপারিশ-পত্র লিখে দিয়ে বিদায় করলেন। থানা বসানোর অজুহাতে মৃগয়া করতে করতে পৌছিয়ে দিলেন মোহনা পর্যন্ত, সেটা প্রায় কুড়ি ক্রোশ পথ। আমি ভাখোর ও মাঁডলগড় হয়ে আমের পৌছলাম। আমের মানসিংহের জন্মভূমি। পথে জায়গায় জায়গায় যুদ্ধের কথা, মানসিংহের জয়লাভের কথা শোনাতে শোনাতে ফিরছিলাম । লোকজন শুনে অবাক হচ্ছিল।

“আমের থেকে পাঁচ ক্রোশ দূরে দলদল-ভূমিতে হাতি আটকে গেল। যতই সে সামনে এগোনোর চেষ্টা করে, ততই তার পা বসে যায়।” মোল্লা খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। লোকজন এসে জানাল : গতবারও এখানে একটা বাদশাহী হাতি আটকে গিয়েছিল। হাতি ওঠানোর একটাই উপায় কলসিতে মশকে জল এনে এনে ঢালতে হবে, তবেই হাতি উঠতে পারবে। ভিস্তীদের ডাকা হলো, তারা প্রচুর জল ঢালল।

লিখেছেন— “অনেক কষ্টে হাতি উঠল। আমরা আমের পৌছলাম। সেখানকার লোকজন আনন্দে আত্মহারা।… আমাদের রাজা যুদ্ধ করে এই বিজয় লাভ করেছেন, বংশের দুশমনের ঘাড় ভেঙে দিয়েছেন, তাঁর হাতি কেড়ে নিয়েছেন! টোণ্ডার উপর দিয়ে যাচ্ছি। এখানেই আমার জন্ম হয়েছিল। তারপর বিসাওয়র।

এখানকার মাটি আমি প্রথম গায়ে মেখেছিলাম।” মোল্লা বদায়ূনে জন্মগ্রহণ করেননি। বিসাওয়র ননিহাল ও পার্শ্ববর্তী টোণ্ডা তাঁর পিতৃগৃহ ছিল। হতে পারে, ননিহালে তাঁর জন্ম হয়েছিল। তারপর কয়েক বছর সেখানেই থাকেন। সেজন্য বিসাওয়রের উপর তাঁর বিশেষ ভালোবাসা ছিল। এখন তিনি একজন বিজেতা হিসেবে রানার হাতি নিয়ে এখান দিয়ে চলেছেন। গ্রামের লোকেরা এক-এক করে দেখতে আসছে। তারা মনে করছে, রানাকে পরাজিত করেছেন তাদের গ্রামের আব্দুল কাদির-ই, সেজন্য সকলে তারা গর্ববোধ করছে। জন্মভূমিতে এমন প্রশংসা ও সম্মান লাভ করে মোল্লা বদায়ূনীর যদি গর্বে বুক ফুলে ওঠে, তাতে আশ্চর্য কি?

অবশেষে ফতেহপুর-সিক্রী পৌঁছলেন। বিজয়-পত্র ও হাতি বাদশাহের সামনে পেশ করা হলো। প্রশ্নের উত্তরে মোল্লা বললেন, হাতির নাম রামপ্রসাদ। আকবর জানালেন : সবই পীরের কৃপায়, তাই এর নাম পীরপ্রসাদ। তারপর তিনি মোল্লাকে বললেন— “পত্রে তোমারও খুব প্রশংসা করে লিখেছে। সত্যি কথা বলো, তুমি কোন বাহিনীতে ছিলে, কি কি কাজ করেছ?” মোল্লা সবিনয়ে সমস্ত বিবরণ দিলেন। বাদশাহ মোল্লাকে তো চিনতেনই, সেজন্য জিজ্ঞাসা করলেন— “যুদ্ধের পোশাক পরে গিয়েছিলে, না এমনিই?”

“জিরাবর (বর্ম) ছিল।”

“কোথায় পেয়েছিলে?”

“সৈয়দ আব্দুল্লা খাঁর কাছ থেকে।”

বাদশাহ খুব খুশি হলেন। মোহরের তোড়ায় হাত ভরে এক আঁজলা আশরফি ইনাম দিলেন । গুনে দেখা গেল ছিয়ানব্বইটি । ১৯৮৫ হিজরীতে (১৫৭৭-৭৮ খ্রিস্টাব্দে) মোল্লা ছুটি নিয়ে বাড়ি গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। সুস্থ হলে দরবারের উদ্দেশ্যে রওনা হন। মালওয়ার দীপালপুরে তখন শাহী শিবির স্থাপন করা হয়েছিল।

আকবরের রাজ্যলাভের দ্বাবিংশপূর্তি উৎসবের ধুমধাম চলছিল। মোল্লা সাহেব সেই বছরই হুসেন খাঁ টুকড়িয়ার মৃত্যু-সংবাদ পান। উভয়েরই মত এক, বিশ্বাস এক। তিনি বন্ধু ছিলেন, মনিবও ছিলেন। যদিও কোনো কারণে দু’জনের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে, তবুও মোল্লার কাছে তিনি অতি সৎ ও খাঁটি ধর্মবীর ছিলেন, কেননা শেষ দিন পর্যন্ত বিধর্মীদের গলা কাটার জন্য তাঁর তরোয়াল উদ্যত ছিল ।

৯৮৫ হিজরীতে মোল্লার বয়স ছিল ছত্রিশ বছর। হজের তীব্র লোভ ছিল। সে- বছর আজমের থেকে বাদশা আবু-তুরাবকে মীর-হাজ (হাজীদের দলপতি) নিযুক্ত করে হাজীদের সঙ্গে প্রেরণ করেন। উপঢৌকনের জন্য বহু জিনিসপত্র দিয়ে নির্দেশ দিলেন, যার ইচ্ছে সেই হজে যেতে পারে। মোল্লা শেখ আব্দুন নবীর কাছে প্রার্থনা জানালেন – আমারও ছুটি মঞ্জুর করিয়ে দিন যাতে আমিও হজে যেতে পারি। শেখ জিজ্ঞাসা করলেন— “মা বেঁচে আছেন?”

মোল্লা জবাব দিলেন— “হ্যাঁ।” “ভাইদের মধ্যে এমন কেউ আছে যে তাঁর সেবাযত্ন করবে?”

“না, শেষ সম্বল বলতে তো আমিই।”

“মায়ের অনুমতি নাও । অনুমতি দিলে ঠিক আছে।”

 

কিন্তু বৃদ্ধা মাতা কিভাবে এতে সম্মতি দিতে পারেন! ফলে তাঁর হজে যাওয়া হলো না । অন্যান্য মানুষের মতো মোল্লারও পরস্পর-বিরোধী গুণ ছিল। একদিকে টুকড়িয়া ও গোড়া মোল্লাদের তিনি আদর্শ ধর্মবীর বলে মনে করতেন, অন্য দিকে তাঁদের বিরোধী আকবরকেও তাঁর পছন্দ ছিল।

সে-বছর পর্যন্ত তিনি আকবরের নীতির সম্পূর্ণ বিরোধী হয়ে ওঠেননি, তখনও তিনি আকবরকে আল্লার প্রতিচ্ছায়া এবং রসুলের দূত মনে করতেন। লিখেছেন— “আমি তখন লশকরদের সঙ্গে রেওয়াড়ী জেলায় ছিলাম। বাড়ি থেকে খবর এল, এক দাসীর পুত্র-সন্তান হয়েছে। দীর্ঘকাল প্রতীক্ষার পরে এই সন্তানের জন্ম। খুশি হয়ে আশরফি উপঢৌকন দিলাম এবং পুত্রের নামকরণের জন্য প্রার্থনা করলাম । বাদশাহ প্রশ্ন করলেন— ‘তোমার পিতা-পিতামহের নাম কি?’ “উত্তর দিলাম— পিতার নাম মলুকশাহ, পিতামহের নাম হামিদশাহ ।’

“তখনকার দিনে ‘ইয়া হাদী’ (হে শিক্ষক)-এর খুব জপ চলছিল। বাদশাহ বললেন— ‘ওর নাম রাখো আব্দুল হাদী।’ হাফিজ মুহম্মদ ইবন্‌ খতিব আমাকে অনেক করে বললেন— ‘নাম রাখার ভরসায় থেকো না। হাফিজদেরও ডাকো, পুত্রের দীর্ঘায়ুর জন্য কুরান পাঠ করাও।’ আমি তাঁর কথায় কান দিইনি, শেষে ছয় মাসের শিশু মারা গেল।”

সেখান থেকেই পাঁচ মাসের ছুটি নিয়ে মোল্লা বিসাওয়র যান। কিন্তু ছুটি শেষ হলেও ফিরলেন না। মজহরী নামের একটি দাসী তাঁর চোখে ধরে যায়। লিখেছেন— “সে ছিল পরমেশ্বরের মহিমা প্রকাশের এক নমুনা। আমি তার প্রেমে পড়ে গেলাম। তার প্রেমে এমন মজে গেলাম যে বছরভর বিসাওয়রে পড়ে রইলাম।”

তখন মোল্লার বয়স চল্লিশ বছর। এই বয়সে বিসাওয়রে তাঁর এক পুত্র মুহিউদ্দীনের জন্ম হয়। দাসী ও স্ত্রীর সংখ্যা কত জানা যায় না। গোনার প্রয়োজনই বা কি, যেখানে নয় থেকে আঠারোজন পর্যন্ত বিবাহিত স্ত্রী শরীয়ত অনুসারে রাখা যেতে পারে । তখন দাস-প্রথার আমল ছিল। পয়সা চাই, যত খুশি দাসী কিনে নিতে পারো। দাস-প্রথা আকবরের পছন্দ ছিল না । তিনি নিজের দাসীদের মুক্ত করে দিয়েছিলেন। তবে দাস-দাসীর মূল্য হিসেবে লোকজনের কোটি কোটি টাকার সম্পদ আটকে ছিল। তাদের সেই সম্পদ ধূলিসাৎ করে দিয়ে তিনি কি বিপদের সম্মুখীন হতে পারতেন।

দীর্ঘকাল অনুপস্থিত থেকে ৯৮৯ হিজরীতে (১৫৮১ খ্রিস্টাব্দে) তিনি ফতেহপুর- সিক্রীর দরবারে হাজির হলেন। দীওয়ানে-খাসে বসে বসে কথাবার্তা চলছিল। আবুল ফজল বললেন— “ইসলাম ধর্মের সমস্ত লেখকদের কাছে দুটি বিষয়ে আমার অভিযোগ রয়েছে— ১. তাঁরা যেভাবে পয়গম্বরের (মুহম্মদের) কথা বর্ষানুক্রমিক লিখেছেন, সেভাবে অন্য পরগম্বরদের কথা লেখেননি।”

মোল্লা বললেন— “কাসাসুল আম্বিয়া’য় নবীদের কাহিনী আছে।” “সে তো হ-য-ব-র-ল, বিশদভাবে লেখা উচিত ছিল।” “প্রাচীনকালের ব্যাপার। ঐতিহাসিক ও ভাষ্যকারেরা হয়তো অতটাই যাচাই করতে পেরেছেন, তাছাড়া আর কোনো তথ্য-প্রমাণ যোগাড় করতে পারেননি।” “এটা উত্তর হলো না। দ্বিতীয় অভিযোগ, এমন কোনো সাধারণ পেশার লোক নেই যার কথা বর্ণনা করা হয়নি। 

কিন্তু পয়গম্বরের নিজের পরিবার এমন কি পাপ করেছিল যে তাদের কথা বলা হয়নি?” মোল্লা কিছু সাফাই দেওয়ার চেষ্টা করলেন, কিন্তু কি জবাব হতে পারে? পয়গম্বরের কন্যা জামাতা ইত্যাদিকে বঞ্চিত করে, তাঁদের অনেককেই লোপাট করে দিয়ে, অন্যরা ইসলামী বিজয়ের মজা লুটেছে। 

পয়গম্বরের রক্ত-সম্পর্কিত যাঁরা, তাঁরাই তো তাঁর আশঙ্কার কারণ ছিল, তাহলে ‘আয় ষাঁড়, আমাকে গুঁতো’ বলতে যাবেন কেন? সেজন্য তাঁদের বিবরণ কখনোই ছাপিয়ে উঠতে দেওয়া হয়নি। মোল্লা আবুল ফজলকে জিজ্ঞাসা করলেন— “প্রসিদ্ধ ধর্মগুলির মধ্যে কোনটা তোমার বেশি পছন্দ?” আবুল ফজল বললেন— “আমার ইচ্ছে, কিছুদিন লা-মজহবীর (ধর্মহীনতার) জঙ্গলে ঘুরে বেড়াই।”

সম্ভবত মোল্লার এতখানি কট্টর হওয়ার প্রয়োজন হতো না, যদি তিনিও আমোদ- প্রমোদে মশগুল হয়ে পড়তেন। ফৈজী ও আবুল ফজলকে আশমানে চড়তে এবং নিজেকে মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাঁর মনে যে অসন্তোষের সৃষ্টি হতো, তা সহজেই বোঝা যায়। যেখানে লোকে হাজার-হাজার লক্ষ-লক্ষ টাকার জায়গির লাভ করেছে, বড় বড় এলাকা জুড়ে তাদের জমিদারী গড়ে উঠছে, সেখানে বেচারা মোল্লা হাজারখানেক বিঘে জমিও সহজে লাভ করতে সমর্থ হননি ।

১১৮৯ হিজরীতে (১৫৮১ খ্রিস্টাব্দে) বাদশাহ কাবুল থেকে ফতেহপুর-সিক্রী প্রত্যাবর্তন করেন। মোল্লাও বছরখানেক পর দরবারে উপস্থিত হন। এমন নয় যে বাদশাহ সেটা জানতেন না । হাজার হলেও তর্ক-বিতর্কে অবশ্যই তাঁর কথা মনে পড়ে থাকবে। তাঁকে দেখে বাদশাহ আবুল ফজলকে জিজ্ঞাসা করলেন— “আমাদের যাত্রায় উনি থাকেননি কেন?” কাবুলের কাছেও তিনি মোল্লার কথা জিজ্ঞাসা করেছিলেন। যাই হোক, আবুল ফজল কিছু একটা বলে প্রসঙ্গ চাপা দিলেন ।

 

মোল্লা বদায়নী দরবার | মোল্লা বদায়নী | আকবর

 

ফকিরীর মধ্যেই সন্তুষ্ট থাকার কথা মোল্লা সাহেব আগে যা বলতেন, এখন তিনি সেটা মেনে নিতে পারছিলেন না । ৯৯৩ হিজরীতে (১৫৮৪-৮৫ খ্রিস্টাব্দে) হাজার বিঘে জমি পেয়েছিলেন, সেজন্য তাঁকে হাজারী বলা যেতে পারত। কিন্তু বারো বছর রাজসেবা করেও তিনি নিজেকে যে অবস্থায় দেখতেন, তাতে তিনি অসন্তুষ্ট ছিলেন এবং অন্য কোথাও ঠাঁই খোঁজার চেষ্টা করেছিলেন। আব্দুর রহমান খানখানা তাঁর সাহিত্য ও বিদ্যোৎসাহিতার জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন। তিনি তখন গুজরাতের রাজ্যপাল।

মোল্লা বদায়ূনীর সঙ্গে তাঁর মোসাহেব মির্জা নিজামুদ্দীনের যথেষ্ট পরিচয় ছিল। তিনি এ ব্যাপারে চেষ্টা করলে খানখানা বলছিলেন— “দেখি, এবার হুজুরের কাছে প্রার্থনা জানিয়ে মোল্লাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসব।” তিনি সিক্রী এলে দীওয়ানখানার পাঠাগারে— যেখানে অনুবাদকেরা বসতেন— খানখানার সঙ্গে মোল্লার সাক্ষাৎ হয়, কিন্তু তাঁকে খুব তাড়াতাড়ি গুজরাত ফিরে যেতে হয়, ভাগ্য মোল্লাকে সহায়তা করেনি। 

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment