মানসিংহের আরম্ভ , আকবর ভারতে একজাতীয়তা প্রতিষ্ঠা করার জন্য মহৎ উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন জাহাঙ্গিরের মোল্লা ও গোঁড়া মুসলমানদের একেবারেই গ্রাহ্য করেননি। এই কাজে হিন্দুদের প্রতিনিধি হিসেবে সবচেয়ে ভারি বোঝা যাঁকে কাঁধে নিতে হয়েছিল, তিনি মানসিংহ। আকবর গোঁড়া মুসলমানদের নজরে ছিলেন বিধর্মী। আকবর ও মানসিংহ তাঁর পিতৃসা ও ভগ্নীর বিবাহ দিয়ে হিন্দুদের কাছে পতিত হয়েছিলেন এবং আজও হিন্দুধর্মের ধ্বজাধারীরা তাঁকে সেই দৃষ্টিতেই দেখে থাকে ।
মানসিংহের আরম্ভ | মানসিংহ | আকবর
পতিত ঘোষণা করে দেওয়া তখনও সহজ ছিল, তবে মানসিংহের জ্ঞাতিগোষ্ঠীরা তাঁকে পতিত করতে পারেনি। মেওয়াড়ের রানা রক্ষণশীলতার পক্ষপাতী ছিলেন। রানা প্রতাপ স্বাধীনতার জন্য প্রাণোৎসর্গ করেছিলেন, তা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। কিন্তু চিরকালের জন্য ভারতে যে দুইটি সংস্কৃতির সমাবেশ ঘটেছিল, যার কারণে রাষ্ট্র দুই বিরোধী শিবিরে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল, তাদের সমন্বয় সাধন অত্যাবশ্যক হয়ে ওঠে। ব্রহ্মপুত্র, গঙ্গা ও সিন্ধু যতই পৃথক পৃথক উৎস থেকে ভিন্ন-ভিন্ন রূপে বয়ে আসুক, সমুদ্রে গিয়ে তাদের এক হতেই হয় ।
প্রাচীনকাল থেকে ভারতে নিষাদ, কিরাত, দ্রাবিড়, গ্রীক, শক, শ্বেত- তূণ, অহোম (থাই) ইত্যাদি পৃথক পৃথক রূপে ভিন্ন-ভিন্ন স্থান থেকে এসেছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা এক স্রোতে লীন হয়ে গেছে। একথা ঠিক, প্রথম বহিরাগত জাতিগুলি ভারতীয় সংস্কৃতিকে সম্মান করেছে, নিজেদের যেটুকু দেওয়ার দিয়েছে এবং নিজেরাও সেই সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মিশে গেছে, কিন্তু মুসলমানদের অবস্থান ছিল তার সম্পূর্ণ বিপরীত।
যেসব বিষয় একান্তই গ্রহণ না করলে নয়, কেবল সেগুলিই তারা গ্রহণ করেছিল। নিজেদের পৃথক সত্তা বজায় রাখার জন্য তারা বিশেষভাবে আগ্রহী ছিল। হিন্দু তাদের সত্তা হারিয়ে তাদের সঙ্গে মিশে যেতে পারে, কিন্তু তারা তা করতে ইচ্ছুক ছিল না । সঙ্গে
এই মনোবৃত্তি বরাবর থাকতে পারে না। একটি প্রয়াস সফল না হলেও এই গুরুতর জাতীয় সমস্যা এড়িয়ে যাওয়া যেতে পারে না। তা বারবার সামনে আসবে এবং শেষ পর্যন্ত সমাধান করিয়েই ছাড়বে। এ ব্যাপারে আকবর কঠিন প্রয়াস চালিয়েছিলেন, আর সেজন্যই তাঁকে বিধর্মী বলা হয়েছিল। তাঁর এই কাজে সহকর্মী ছিলেন মানসিংহ ।
যে-সময়ে আকবরের জন্ম, সে-সময় ধর্ম-সম্প্রদায়গুলির ঘাতক চেহারা দেখে সেগুলিকে একদম খারিজ করে দেওয়া সম্ভব ছিল না। খারিজ না করতে হলে কেবল দু’টি পথ ছিল— ১. সকল ধর্মের সমন্বয়, কিংবা ২. সেগুলির পরিবর্তে এক নতুন ধর্মের প্রবর্তন। তিনি সমন্বয়ের পক্ষপাতী ছিলেন, সকল ধর্মকে এক দৃষ্টিতে দেখতেন । কিন্তু কবীর, নানকের মতো সমন্বয়বাদীরা আগেই ব্যর্থ হয়েছিলেন।
ওই দু’জন জাতিগুলির মানসিক সম্পর্কই ঠিকমতো গড়ে তুলতে পারেননি, ভৌতিক সম্পর্ক স্থাপন তো দূরের কথা। সম্ভবত সেজন্যই আকবরকে দীন-ইলাহীর ভিত্তিস্থাপন করতে হয়েছিল। মানসিংহ আকবরের কাছে নিজের সহোদর ভ্রাতার চেয়েও প্রিয় ছিলেন — সহোদর ভ্রাতা মুহম্মদ হাকিমের বিদ্রোহ দমনের ভার দেওয়া হয়েছিল মানসিংহকে। মানসিংহ আফগানিস্তান পর্যন্ত শাসনকর্তা ছিলেন। কিন্তু তিনি দীন-ইলাহীতে সামিল হতে সম্মত ছিলেন না। দীন-ইলাহীর পয়গম্বর স্বয়ং বাদশাহ, খলীফা আবুল ফজল এবং চার নম্বরের নেতা ব্রাহ্মণ বীরবল ছিলেন ।
লোক খুব আগ্রহের সঙ্গে— উপর উপর কিংবা আন্তরিকভাবে শাহী ধর্মে যোগ দিচ্ছিলেন। অনেকেই আশা পোষণ করছিলেন যে মানসিংহ এই নতুন ধর্মে যোগ দেবেন, কিন্তু প্রস্তাব এলে মানসিংহ বললেন— “যদি চেলা হওয়ার অর্থ প্রাণোৎসর্গ হয়, তাহলে আপনি তা নিজের চোখেই দেখছেন। যদি প্রয়োজন বোধ করেন, তাহলে পরীক্ষা দেওয়ার জন্যও আমি প্রস্তুত। যেখানে ধর্মের প্রশ্ন, সেখানে আমি হিন্দু । আমার নতুন ধর্মের প্রয়োজন নেই।” তখনকার নতুন ধর্মের গঠন ছিল, আমাদের দেশে এই শতাব্দীতে যেমন থিয়োসোফীর গঠন— যাতে হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, সকলেই যোগদান করতে পারেন ।
মানসিংহের পথে প্রতিবন্ধকতা ছিল। পিতৃস্বসা, ভগ্নীকে বাদশাহ-শাহজাদার হাতে সমর্পণ করার জন্য লোকে পূর্ব থেকেই তাঁর বদনাম রটাচ্ছিল। খাঁটি হিন্দু থাকার উৎসাহ তো ছিলই, তাই রানাদের বংশের সঙ্গে তাঁর বংশের অন্নজল কন্যাদান বিষয়ে কোনো বাধা-নিষেধ তৈরি হয়নি।
রাজপুতরাও খুব শীঘ্রই মানসিংহের নীতি স্বীকার করে নিয়েছিলেন, জয়পুর বাদ দিয়ে সকলেই বাদশাহের পরিবারে বিবাহ-সম্বন্ধ স্থাপন করেছিলেন। তবে হ্যাঁ, সেটা ছিল একতরফা কারবার : কন্যাদান করা হতো, শাহজাদী গ্রহণ করা হতো না। আকবর চেয়েছিলেন, উভয়পক্ষেই রক্ত-সম্পর্কের আদান-প্রদান করা হোক।
সেই বছরই (১৫৫৬ খ্রিঃ) এক রাজপুত যুবরাজ রাজপুতদের এই নিয়ম ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন— কন্যা দান করলে রক্ত কলুষিত হয় না, কারণ আমরা তো তাকে কেটে বাইরে ফেলে দিচ্ছি। কিন্তু কন্যা গ্রহণ করলে রাজপুত-রক্ত অশুদ্ধ হয়ে পড়ে। সাধারণ হিন্দুদের কাছে কন্যা গ্রহণ করার চেয়ে কন্যা দান করা অধিকতর লজ্জার বিষয়, কিন্তু রাজস্থানের রাজপরিবার এ ব্যাপারে যে ধরনের ব্যাখ্যা দিয়েছিল, আকবর ও তাঁর অনুগামীদের স্বপ্ন-পূরণের পথে তা বাধাস্বরূপ হয়ে দাঁড়ায়।
যাই হোক, যাঁরা এক নব্য-ভব্য ভারতের স্বপ্ন দেখেছিলেন, তাঁদের মধ্যে আকবরকে বাদ দিলে অবশ্যই মানসিংহের নাম উল্লেখ করা যায় । যদি সেই স্বপ্ন সার্থক হতো, তাহলে ভারত কখনোই পরাধীন হতো না, দেশ-বিভাগও হতো না ।
মানসিংহের জন্ম হয় আমেরে ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দে। তখনও বসনা ও কওয়াদের রাজধানী হয়ে উঠতে জয়পুরের অনেক দেরি। রাজা বিহার মলরা ছিলেন পাঁচ ভ্রাতা— বিহারীমল, পূরণমল, রূপসী, আস্করন ও জগমল। রাজা বিহারীমলের পরে তার পুত্র ভগবানদাস সিংহাসন লাভ করেন। ভগবানদাসের কোনো পুত্র ছিল না । তিনি তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র মানসিংহকে পুত্র হিসাবে লালন-পালন করেন ।
আকবর সিংহাসনে বসেন ১৫৫৫-৫৬ খ্রিস্টাব্দে। সেই বছরই তেরো-চৌদ্দ বছরের বালক কুমার মানসিংহ-সহ রাজা ভগবানদাস আকবরের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পান। মজনু খাঁ কাকশালকে নার্নওলের (পাটিয়ালা) হাকিম করে পাঠানো হয়। শেরশাহের জন্মদানের সৌভাগ্য হয়েছিল নারনওলেরই।
হাজী খা শেরশাহের অমাত্য ছিলেন। তিনি মজ্যঁ খাঁর উপর আক্রমণ চালান । রাজা বিহারীমল হাজী খাঁর সহায়ক ছিলেন। পিছনে কছ্ওয়াহাদের ক্ষমতা থাকার ফলে মজনু খার পক্ষে আক্রমণের মোকাবিলা করা সহজ ছিল না। বিহারীমল এই সময় সাহায্য করেন, হাজী খার সঙ্গে কথাবার্তা চালিয়ে মজনু খাকে অবরোধ-মুক্ত করে দেন। মজনু খা দরবারে এসে কছওয়াহা রাজার অত্যন্ত প্রশংসা করেন। দরবারের হর্তা-কর্তা বৈরাম খা খানখানা (আব্দুর রহীম খানখানার পিতা) গোঁড়া মুসলমানের রাজনীতি করতেন না।
ফরমান গেলে রাজা বিহারীমল দরবারে উপস্থিত হন। হেমুর পরাজয়ের পর আকবর দিল্লীতে এসে গিয়েছিলেন। শহরে বাদশাহের শোভাযাত্রা বেরিয়েছিল। চকিত শাহী হাতি কখনো এদিকে কখনো ওদিকে মুখ ঘোরাচ্ছিল, দর্শকেরা ভয়ে দৌড়ে পালাচ্ছিল, কিন্তু রাজপুত নিজের জায়গায় অবিচল থাকে। এই দৃশ্যের দারুণ প্রভাব পড়ে আকবরের উপর। তখনও তিনি তেরো-চোদ্দ বছরের বালক মাত্র, খেলাধূলার বয়স, সেজন্য তাঁর মুখ থেকে একজন গম্ভীর রাজনীতিজ্ঞের মতো বাক্য উচ্চারণ যে পরে দরবারে সদস্যদের মধ্যে যথেষ্ট আলোচনার বিষয় হয়ে উঠবে, তাকে সন্দেহ নেই।

কথিত আছে, সে-সময় আকবর রাজা বিহারীমলকে বলেছিলেন— “তুরা বিহাল খওয়াহম্ কর্দ, আন্করীব্ মী-বীনী কি এজাজ্-ওয়া-ইতে খারত্ জিয়াদ-বর্জিয়াদ মী-শওয়দ্” (তোমাকে খুশি করে দেবো, খুব শীঘ্রই দেখবে তোমার মান-সম্মান ক্রমশ বেড়ে চলেছে।। মির্জা আশরুফুদ্দীন হুসেনকে মেওয়াতের হাকিম নিযুক্ত করা হয়েছিল । তিনি আমেরের কয়েকটি অঞ্চল দখল করতে চেয়েছিলেন। রাজার বিরুদ্ধাচারী ভ্রাতা সহায়তা করেছিলেন বলে মির্জা তাতে সফল হয়েছিলেন।
আরও দেখুনঃ