Site icon History Gurukul [ ইতিহাস গুরুকুল ] GDCN

রহীমের বাল্যকাল | রহীম | আকবর

রহীমের বাল্যকাল | রহীম | আকবর

রহীমের বাল্যকাল , প্রথম হিন্দু যুগে সর্বেসর্বা ছিলেন মুসলমান কবি— মঞ্চন, কুতুবন, জায়সীর কৃতিত্ব দেখেই তা বোঝা যায় । তাদের পূর্বে মৈথিলীর বিদ্যাপতি ও কাশীর কবীরই হিন্দী-গগনে উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন। তারপর আকবরের আমল এল, তখন হিন্দী কবিতার বহুতর বিকাশ সাধনের সুযোগ হল।

রহীমের বাল্যকাল | রহীম | আকবর

 

 

এই যুগে যেখানে সুরদাস ও তুলসীদাসের মতো সূর্য- চন্দ্রের উদয় হল, সেখানে রহীমও আমাদের কবিতার উন্নয়ন-সাধনে সহায়ক হলেন। তার দোঁহা তুলসীদাসের চৌপদীর মতো লোকের মুখে লেগে থাকে, এই থেকেই বোঝা যায় যে তার কবিতা কত মর্মস্পর্শী। তার এক-একটি দোঁহা বিন্দুতে সিন্ধুর মতো গভীর অর্থবহ ও বহুদর্শিতার নিদর্শন। সাম্প্রদায়িক সঙ্কীর্ণতার গন্ধও পাওয়া যায় না তাঁর কবিতায় ।

এত উদারতার কারণ কি, সেটা অনুভব করা খুব কঠিন নয় । আমরা জানি যে চার বছরের রহীম তরো বছর বয়সী আকবরের ছত্রছায়ায় মানুষ হয়েছিলেন— সেই আকবর, যিনি সাম্প্রদায়িকতাকে কেবল নিজের মন থেকেই দূর করেননি, দেশবাসীর মন থেকেও নির্মূল করতে চেয়েছিলেন। রহীমের পিতা বৈরাম খানখানাও তাঁর মতোই উদার ছিলেন।

তিনি নিজে শিয়া ছিলেন যা তাঁদের কয়েক পুরুষ ধরে চলে আসছিল। ভারতবর্ষে তখন সুন্নীদের খুব প্রতাপ, শিয়াদের উপর ফতোয়া পুরুষ ধরে চলে আসছিল। ভারতবর্ষে তখন সুন্নীদের খুব প্রতাপ, শিয়াদের উপর ফতোয়া জারি হতে বিলম্ব হতো না । সেজন্য অন্তরে শিয়া হলেও বাইরে সুন্নী দেখাতে হতো। বাবর একবার শিয়া শাহ ইসমাইলের কৃপাপাত্র হয়েছিলেন এবং শিয়াও ছিলেন। হুমায়ূনও আশ্রয় পেয়েছিলেন ইরানের শিয়া বাদশাহের কাছে। এ কথাও বলা যায় যে তিনিও মনে মনে শিয়া ছিলেন। শিয়া সম্প্রদায় ইরানে সাংস্কৃতিক উদারতার বিস্তার ঘটিয়েছিলেন, ভারতেও তাঁদের চিন্তাভাবনা উদার ছিল ।

পিতার উপর যদি শিয়া হওয়ার সন্দেহ পোষণ করা হয়, তাহলে পুত্রের উপর সে-সন্দেহ হবে না কেন, বিশেষত তাঁর উদারতার কাছে হিন্দু-মুসলমানে কোনো পার্থক্য ছিল না। হিন্দুদের ভাষায় কবিতা রচনা করতেন, হিন্দু কবিদের মুক্তহস্তে সাহায্য করতেন। কিন্তু তৎকালে সেই সন্দেহের শিকার ছিল আরও অনেকেই। আকবরের মহামন্ত্রী আবুল ফজল এবং তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা তথা তদানীন্তন অদ্বিতীয় পণ্ডিত ফৈজীকে শিয়া বলা হতো। উভয়ের পিতা মুবারককে তো তাঁর উদার মনোভাবের জন্য অনেক দুর্ভোগ পোয়াতে হয়েছিল ।

মাঝখানের কিছু সময় সৈয়দ, লোদী ও শূরী রাজবংশকে বাদ দিলে দিল্লীর মুসলমান শাসকেরা সকলেই তুর্কি ছিলেন। দাস, খিলজী ও তুগলক— এই তিন মধ্য-এশিয়ার তুর্কি এবং শেখ মোগল রাজবংশও। তুর্কিদের প্রতি এই রাজবংশগুলির বিশেষ পক্ষপাতী হওয়া স্বাভাবিক ছিল।

মুসলমান আমলের শেষ দিকে তো চারটি রাজনীতিক গোষ্ঠীর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। তাদের মধ্যে ইরানী গোষ্ঠীর নেতা মুর্শিদাবাদ ও লখনউয়ের শিয়া নবাব ছিলেন। পাঠানদের একটি সুদৃঢ় দল ছিল তাদের মধ্যে প্রাধান্য ছিল বঙ্গাশ ও রুহেলদের। তৃতীয় গোষ্ঠী দেশীয়, তাদের নেতা ছিলেন সৈয়দ-বন্ধু। চতুর্থ গোষ্ঠীটিকে শাহী বলে গণ্য করা হতো, তাদের বলা হতো তুরানী। তুর্কিদের মধ্য-এশিয়ার দেশভূমিকে তুর্কিস্তান ও তুরান উভয়ই বলা হতো। শুরুতে ভূরানী দল সবচেয়ে বলিষ্ঠ ছিল। 

বাবর-হুমায়ূন-আকবর-জাহাঙ্গিরের আমলে এই দলের ক্ষমতা ছিল দুর্দান্ত। ভুরানে (তুর্কিস্তানে) কয়েকটি তুর্কি জাতি ছিল। বর্তমানে তাদেরই প্রতিনিধি কজাক, কির্গিজ, উজবেক, তুর্কমান। বাবর ও তার বংশধরেরা অধুনা উজবেকিস্তান থেকে এসেছিলেন। যদি ভাষা ও জাতির নিরিখে বিচার করা হয় তাহলে তাঁদের উজবেক বলা যেতে পারে। কিন্তু মঙ্গোল খান উজবেকের বংশধর শয়বানী খান বাবরকে মধ্য-এশিয়া থেকে বিতাড়িত করছিলেন, সেজন্য তিনি উজবেকের নাম পর্যন্ত শুনতে রাজি ছিলেন না।

আসলে শয়বানী বংশই দেশের নাম রেখেছিলেন উজবেক। তার পূর্বে বাবরের সময় তারা নিজেদের বলত চগতাই। চগতাই শ্রেষ্ঠ বিজেতা চেঙ্গিস খানের দ্বিতীয় পুত্র ছিলেন। তিনি মঙ্গোল ছিলেন, যদিও তাঁর প্রজারা সেখানকার জনগণ— তুর্কি ছিল। যাই হোক, বাবরের অনুগত তুর্কিরা, তাঁর পৌত্রের আমলেও নিজেদের চগতাই বলত। বৈরাম খাঁ চগতাই নন, এমনকি তুর্কমানরাও তুরানী দলের অভিন্ন অঙ্গ ছিল। মোগল আমলের অন্তিমকালে তুরানী দলের নেতা নিজামুল-মুলকও তুর্কমান ছিলেন, তিনি হয়দরাবাদে নিজের রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।

পূর্বপুরুষ তৈমূরের বিজয় অভিযান বৈরামের ক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছিল। তিনি বড় বড় পদে অধিষ্ঠিত থেকে প্রভুর সেবা করেছিলেন। কারাকুলু তুর্কমানদের উপসাগরীয় যোগ্যতম নেতা ইয়ার আলী বাবরের আমলে রাজকার্যে নিযুক্ত ছিলেন । ইয়ার আলীর পুত্র সয়ফ্ আলী মোগলদের তরফ থেকে আফগানিস্তানে শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। তাঁর পুত্র বৈরাম আলী যখন ছোট, তখনই পিতার মৃত্যু হয়। তিনি হুমায়ূনের সমবয়স্ক ছিলেন। তিনি তাঁর কর্মদক্ষতায় হুমায়ূনকে এবং পরবর্তীকালে বাবরকে সন্তুষ্ট করেন।

তাঁদের বংশে সাহিত্য ও সঙ্গীত চর্চা বরাবরই ছিল। বৈরামের পরিবারে গায়ক ও বাদ্যকরদের খুবই সম্মান ছিল। তিনি নিজে তাঁর মাতৃভাষা তুর্কি ও ফারসির কবি ছিলেন। যোগ্যতার ব্যাপারে কি বলব? হুমায়ূনের পুনরায় ভারতের সিংহাসন-লাভের ক্ষেত্রে বৈরাম খাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। হুমায়ূনের সময়েও সাম্রাজ্যের দেখাশোনা বৈরামের হাতে ছিল এবং আকবরের শাসনকালের প্রারম্ভিক পর্বে তাঁর আধিপত্য কতদূর বিস্তৃত ছিল, তা সকলেই জানেন ।

 

 

বৈরাম খাঁর কয়েকটি পত্নী ছিলেন, তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন হুমায়ূনের ভাগিনেয়ী সলীমা। এ থেকেই বোঝা যায়, বাদশাহী খানদানের সঙ্গে বৈরাম খাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। কয়েকজন বেগম থাকা সত্ত্বেও বৈরাম খাঁ সন্তান লাভ করেন অনেক দেরিতে। তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র রহীমের জন্ম হয় পিতার মৃত্যুর চার বছর পূর্বে এবং তিনি রাজকন্যাদের গর্ভজাত সন্তান ছিলেন না। তাঁর মাতা ছিলেন হাসান খাঁ মেওয়াতীর ।

মামা তাঁর ‘মেঘ’ জনগোষ্ঠীর সর্দার ছিলেন। এখনও তারা বহুসংখ্যায় ভ্রাতুষ্পুত্রী । রোহতক-ভরতপুরে বসবাস করছেন। মুসলিম শাসনের গোড়ার দিকে হিন্দু মেঘেরা দিল্লীর শাসকদের নাজেহাল করে তুলেছিল। পরে তারা সকলেই মুসলমান হয়ে যায়। হাসান খাঁ মেওয়াতীর এক ভ্রাতুষ্পুত্রী (জামাল খাঁর কন্যা) রহীমের মাতা ছিলেন এবং মাতৃসা ছিলেন আকবরের বেগমদের একজন। আব্দুর রহীমের জন্ম ১৬৪ হিজরীর ১৪ই সফর (মঙ্গলবার, ১৭ই ডিসেম্বর, ১৫৫৬ খ্রিঃ) লাহৌরে। রহীমের জন্মের কয়েক মাস পূর্বে পানিপথের যুদ্ধে হেমু পরাজিত হলে মোগল সাম্রাজ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।

দিল্লীর সিংহাংসনে হুমায়ূনের পুনঃপ্রতিষ্ঠায় বৈরাম খাঁ সবচেয়ে বড় সহায়ক ছিলেন, এ কথা আগেই বলেছি। আকবর যখন সিংহাসনে বসেন, তখন তার বয়স ছিল মাত্র তেরো বছর। বৈরাম খা যেখানে পিতাকে আঙুলে নাচাতেন, সেখানে তাঁর পুত্রকে যদি তিনি দুগ্ধপোষ্য শিশু মনে করেন, তাতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। আকবরের বয়স তেরো থেকে সতেরো হতে হতে বৈরাম খাঁর আধিপত্য অস্তমিত হতে শুরু করে।

আকবর তাঁর সামনে তিনটি প্রস্তাব রাখেন : হয় আপনি দরবারে সভাসদ হয়ে থাকুন, কিংবা চাঁদেরী-কালপী জেলার হাকিম হয়ে চলে যান, না-হলে হজ করতে যান। খানখানা যে জায়গায় পৌছেছিলেন, সেখান থেকে নিচে নামার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না । তিনি হজে যেতেই সম্মত হলেন।

চার বছরের আব্দুর রহীম পিতার সঙ্গেই ছিলেন। গুজরাতের খম্ভাত বন্দর থেকে মক্কা-গামী জাহাজ ধরার কথা ছিল। বৈরাম খাঁ পাঠানদের সঙ্গে যেরকম ব্যবহার করেছিলেন, তাতে তারা তাঁকে ক্ষমা করতে রাজি ছিলেন না। তিনি পাটনে পৌছলে তিরিশ-চল্লিশ জন পাঠানকে সঙ্গে নিয়ে মুবারক খাঁ লোহানী তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসে এবং করমর্দনের অজুহাতে বৈরাম খাঁর পিঠে তরোয়াল বসিয়ে দেয়।

তরোয়ালে তাঁর শরীর এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে গিয়েছিল। তারপর তাঁর মাথায় তরোয়ালের এক কোপ দিয়ে তাঁকে শেষ করে দেওয়া হয়। হত্যাকারী বলেছিল— এই লোকটা মাছিওয়াড়ায় আমার পিতাকে হত্যা করেছিল, আজ তার প্রতিশোধ নিলাম ।

৯৬৮ হিজরীতে (১৫৬০ খ্রিস্টাব্দে) রহীম অনাথ হয়ে পড়েন। তাঁর এক মাতৃসা আকবরের বেগম ছিলেন। সেই সংবাদ এসে পৌছলে আকবর অত্যন্ত দুঃখবোধ করেন । সলীমা সুলতান বেগম চার বছরের শিশুকে নিয়ে কোনোরকমে আহমদাবাদে এসে পৌঁছান।

দরবারে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল না । আগরা যাত্রার আয়োজন করতেই চার মাস সময় অতিবাহিত হয়। আকবর শোক সংবরণ করে মাতা ও শিশুকে সসম্মানে দরবারে নিয়ে আসার আদেশ দেন। সলীমা সে-আদেশ পান জালোরে। আগরায় এলে রাজপ্রাসাদে তাঁদের নামানো হয়।

আকবর রহীমের উপর দয়াপরবশ সলীমাকে বেগমের মর্যাদা দান করেন। রহীমকে তাঁর কাছে নিয়ে এলে আকবর অশ্রুপাত করতে করতে তাঁকে কোলে তুলে নিয়েছিলেন। লোকজনকে কঠোরভাবে সাবধান করে দিয়েছিলেন, শিশুর সামনে কেউ যেন খানবাবার (বৈরাম খাঁর) কথা উল্লেখ না করে, জিজ্ঞাসা করলে যেন বলে, তিনি খোদার ঘরে হজ করতে গেছেন। এভাবেই ১৫৬০ খ্রিস্টাব্দে রহীম আকবরের পুত্র-প্রতিম হন। আকবর তাঁকে মির্জা খাঁ বলে সম্বোধন করতেন। রহীমের পিতা সাহিত্য-সঙ্গীত-শিল্পে অভিজ্ঞ ছিলেন।

 

 

রহীমের মানসিক গঠনে তাঁর আস্থাভাজন কর্মচারীদের ও পরিবারবর্গের হাত ছিল। তাঁর শিক্ষা-দীক্ষার প্রতি আকবর বরাবর খেয়াল রাখতেন। তুর্কি ও ফারসি রহীমের মাতৃভাষা ছিল। মাতা যেহেতু হরিয়ানার মানুষ ছিলেন, সেহেতু হিন্দীও ছিল তাঁর প্রায়-মাতৃভাষা। তিনটি ভাষাতেই রহীমের যথেষ্ট দখল ছিল। আরবিও তিনি ভালোই পড়তে পারতেন— ভারতে আরবি যদিও রাজভাষা নয়, তথাপি ধর্ম ও দর্শনের জন্য তার উচ্চস্থান গণ্য করা হতো ।

অসাধারণ রূপবান তরুণ ছিলেন রহীম। চিত্রকরেরা তাঁর প্রতিকৃতি করতেন, আমিরেরা তাঁদের বৈঠকখানা সাজানোর জন্য তা টাঙাতেন। জ্ঞানলাভ করতে করতেই শায়ের ও কবি, সঙ্গীতজ্ঞ ও চিত্রশিল্পীদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক গড়ে ওঠে ।

আরও দেখুনঃ

Exit mobile version