টোডরমল শ্ৰেষ্ঠ প্ৰশাসক, মোল্লা এবং আরও অনেকেই টোডরমলকে পছন্দ করতেন না, কারণ তিনি খুব কড়া লোক ছিলেন, হিসেবের গরমিল থেকে কেউ তার হাত থেকে রেহাই পেতেন না । বদায়ূনী নিজে তাঁর কাজকর্ম সম্বন্ধে লিখেছেন— ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে আকবর সাম্রাজ্যের সুবন্দোবস্তের জন্য প্রতি ‘করোড়” আয়ের এক-একটা অঞ্চল গঠন করতে মনস্থ করেন।
টোডরমল শ্ৰেষ্ঠ প্ৰশাসক | টোডরমল | আকবর
এই হিসেবে গোটা দেশকে এক শত বিরাশি ভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে। এক কোটি মানে এক কোটি দাম। দাম, দ্রম্য অথবা ড্রা-এর হিসেবে এক গ্রীক মুদ্রা— ব্যাকট্রিয়-গ্রীকদের রৌপ্য মুদ্রা— যা এক টাকার কাছাকাছি হতো। অথচ আকবরের আমলে দাম তাম্র মুদ্রাই থেকে গিয়েছিল।
এতে ৩১৫ থেকে ৩২৫ গ্রেন তামা থাকত। ডবল দাম-ও হতো, আমাদের দেশে ইংরেজ আমলে তাকে বলা হতো ডবল পয়সা। তাতে তামা থাকত ৬১৮ থেকে ৬৪৪ গ্রেন পর্যন্ত। আকবরী টাকা আমাদের টাকার প্রায় সমতুল্যই ছিল, অর্থাৎ ১৭.২৫ গ্রেন (১৫ গ্রেন মাস)। দাম-কে ২৫ জীতলে ভাগ করা হয়েছিল হিসেবের সুবিধার্থে, জীতলের কোনো মুদ্রা ছিল না। এক টাকা সমান ৪০ দাম ধরা হতো, অর্থাৎ এক কোটি দাম-এর অর্থ আড়াই লক্ষ টাকা। আড়াই লক্ষ টাকা আয়ের এক-একটি ‘করোড়’ মহল বানানো হয়েছিল, যার অমাত্যকে আমিল অথবা করোড়ী বলা হতো ৷ বদায়ূনীর কথায়—
“এক করোড়ের নাম রাখা হলো আদমপুর। দ্বিতীয়টার নাম শেখপুর, তৃতীয়টার আয়ুবপুর। এইভাবে অন্যান্য পরগম্বরদের নামে অন্যান্য করোড়। এর জন্য অমাত্য ‘করোড়ী’ নিযুক্ত করে দেওয়া হলো। তারা কোনো নিয়ম-নীতি মানত না । করোড়ীদের লুঠপাটের ফলে দেশের অধিকাংশ অঞ্চল উজাড় হয়ে গেল । স্ত্রী সন্তান-সন্ততি বিক্রি করে দেওয়ার ফলে কত প্রজার পরিবার ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল।
প্রত্যেক জায়গায় চরম অব্যবস্থা। টোডরমল করোড়ীদের ভালোরকম শাস্তি দিয়েছিলেন। অত্যাচার করার জন্য কতজনকে মেরে ফেলা হয়, কতজনকে বেদম প্রহার করা হলো। শাসন করতে কিছুই বাকি রইল না। বহুসংখ্যক ভূমি-রাজস্ব আধিকারিক করেদখানায় দীর্ঘকাল পড়ে থাকতে থাকতে মারা গেল, জল্লাদ বা তরোয়াল দিয়ে হত্যা করার লোকের দরকার ছিল না কেবল তাদের কবর ও কাফন দেওয়ার প্রয়োজন ছিলো |
জনসাধারণের লুণ্ঠনকারী অমাত্যদের এমন কঠোর হস্তে দমন করেন যিনি, সেই সর্বজনপ্রিয় ব্যক্তি কি তাদের প্রিয় হতে পারে! “প্রভু কান পেতে রয়েছেন কাজের কথা শোনার জন্য।” এই পঙ্ক্তিটি যেন সমসাময়িক শ্রেষ্ঠ কবি তুলসীদাস টোডরমলের উদ্দেশেই লিখেছিলেন— এক টোডরমল
তুলসীদাসেরও ভক্ত ছিলেন, কিন্তু তিনি এই টোডরমল নন। বারানসীতে তাঁর বসবাসের কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না। তিনি অবশ্যই হরদওয়ারে গঙ্গাতীরে বসবাস করতে সঙ্কল্প করেছিলেন, কিন্তু তাঁর সেই আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হয়নি। টোডরমলের পায়ের কাছে ধনসম্পদ মান-সম্মান আপনা থেকেই এসেছিল, কিন্তু মান-সম্মানের উপর নয়, আগ্ৰহ ছিল কাজের উপর। তার মতো রণকুশল ব্যক্তি আকবরের নিকটে বেশি ছিলেন না।
তিনি বাংলা-গুজরাত-পশ্চিমোত্তর সীমান্তে তাঁর রণকৌশল বহুবার প্রদর্শন করেন, কিন্তু তাঁর মনে কখনও বাসনা জাগেনি যে তিনি সেইসব যুদ্ধের প্রধান সেনাপতি হবেন। কোনো না কোনো সেনাপতির সহযোগী হয়েই তিনি তাঁর প্রভুর কাজ করতে চেয়েছিলেন। যুদ্ধের জন্য সৈন্যের অস্ত্রশস্ত্র ধারণ ও সঞ্চালন খুবই দক্ষতার কাজ, কিন্তু তার চেয়েও বড় কাজ : সৈন্যের রসদ, রসদ সরবরাহ দপ্তরের সঠিক বন্দোবস্ত করা।
নদীপথে হাজার হাজার নৌকার প্রয়োজন হতো, সেই পরিমাণে লক্ষ লক্ষ লোকের খাদ্যসামগ্রী ও তা সময়মতো সরবরাহের আবশ্যকতা ছিল, টোডরমল ভূমি ও অর্থ- ব্যবস্থার মতোই সে-কাজও অনায়াসে সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন করতেন।
১৫৮২ সালে তাঁরই পরামর্শমতো মুদ্রা-সংস্কার করা হয়। জীতল, দাম, ডবল দাম, টাকা ইত্যাদির সংস্কার-সাধন করা হয়, যদিও তা করেছিলেন শেরশাহ, তবে তাকে আরও সুশৃঙ্খল রূপ দেওয়ার কাজ ছিল টোডরমলের। তিনি দফতরের হিসেব সংরক্ষণের নিয়ম-নীতি প্রবর্তন করেন। তবে এমন কোনো বিষয় নেই, যার কৃতিত্ব আমরা কেবল তাঁকেই দিতে পারি।
‘খজানে-ইস্রার’ (অর্থ-রহস্য) নামক একখানি ফারসি পুস্তক সম্পর্কে শামশুল-উমা আজাদ বলেছেন- “আমি অনেক চেষ্টায় গ্রন্থখানি কাশ্মীরে পাই। কিন্তু ভূমিকা দেখে বিস্মিত হলাম কেননা সেটি ১০০৫ হিজরীর (১৫৯৬-৯৭ খ্রিস্টাব্দের), অথচ তাঁর মৃত্যু হয় ১৫৮৯ খ্রিস্টাব্দে। সম্ভবত তাঁর স্মারকগ্রন্থে কেউ ভূমিকা জুড়ে দিয়েছে। …তাতে দুটি ভাগ আছে— একটিতে ধর্ম, শিক্ষা, উপাসনা, পূজা-পাঠ ইত্যাদি ইত্যাদি, এবং দ্বিতীয় ভাগে রয়েছে জাগতিক বিষয়।
দুই ভাগেই ছোট ছোট অনেক অধ্যায় আছে। প্রত্যেক ব্যাপারে কিছু কিছু আলোকপাত করা হয়েছে— আচার ও জীবনোপায় ছাড়াও তার মধ্যে রয়েছে শিল্প, সঙ্গীত, শাকুনবিদ্যা… ইত্যাদি ইত্যাদি । এই পুস্তক থেকে আরও জানা যায়, তিনি তাঁর ধর্মে একনিষ্ঠ এবং ধর্মের বিধি-নিষেধে পূর্ণ বিশ্বাসী ছিলেন, সর্বদা ধর্মচর্চা-উপাসনায় কাটাতেন, পূজা-পাঠ ও ধর্মীয় বিধি-বিধান অক্ষরে অক্ষরে পালন করতেন।” লিখনপটুতা সত্ত্বেও টোডরমল তাঁর লেখনীকে দফতরের কাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন।
সেজন্য এক্ষেত্রে আবুল ফজলের মতো তাঁর প্রতিভা দেখা যায়নি। তখন ‘দীন-ইলাহী’র খুব রমরমা, কিন্তু টোডরমলের উপর তার কোনো প্রভাব পড়েনি। আকবর সাত খুন সাফ করে দেওয়ার মানুষ ছিলেন। তিনি গুণের কদর করতেন,, দোষ-ত্রুটি উপেক্ষা করে চলতেন। এমন একজন যোগ্য মানুষ দীন-ইলাহী’-তে যোগ দিন—এটা চাইবেন না কেন আবুল ফজল? তিনি লিখেছেন— “বাদশাহ তাঁকে দীওয়ানকুল করে তাঁর বিচক্ষণতার উপর আর্থিক ও রাষ্ট্রীয় সমস্যা ছেড়ে দেন। তিনি সৎ ও নির্লোভ, ভালো রাজসেবক ।
বিনা লোভে কাজকর্ম করেন। কত না ভালো হতো যদি তাঁর মধ্যে দ্বেষ ও প্রতিশোধ-স্পৃহা না থাকত। তাঁর মন থেকে এক-আধটু কোমলতা ফুটে বেরুতো। এ কথা ঠিক, যদি ধর্মীয় পক্ষপাতিত্বের রঙ তার চেহারায় ধরা না পড়ত, তাহলে তাঁকে এতটা নিন্দার পাত্র হতে হতো না। এসব সত্ত্বেও বলতেই হয়, সর্বান্তঃকরণে তিনি নির্লোভ, পরিশ্রমী এবং গুণগ্রাহী রাজকর্মচারী ছিলেন। এমন মানুষের দৃষ্টান্ত খুব কম, এ কথা না বলে বলা ভালো, নজিরবিহীন।”
দাগের নিয়ম— আকবরকে প্রথম থেকেই যুদ্ধের ভিতর দিয়ে চলতে হয়েছিল এবং মৃত্যুর কাছাকাছি সময় পর্যন্ত যুদ্ধ তার পিছু ছাড়েনি। তিনি যখন সমগ্র ভারতকে ঐক্যবদ্ধ ও সুদৃঢ় দেখতে চান, তখন তিনি কি অল্পে সন্তুষ্ট হতে পারেন? তিনি সাম-দম নীতির সাহায্যেই কার্যোদ্ধার করতে চাইতেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত মীমাংসা হতো তরোয়ালেই।
সেজন্য সর্বদা সেনা প্রস্তুত রাখা জরুরি মনে করতেন। সে-সময় সুবার অমাত্যকে বলা হতো সিপাহসালার (সেনাপতি) এবং সরকারের (জেলার) অমাত্যকে বলা হতো ফৌজদার। এই থেকেই উপরোক্ত বক্তব্য প্রতীয়মান হয়। অসামরিক ব্যবস্থা সামরিক বন্দোবস্তের অধীন ছিল, সেজন্য সৈন্যসংখ্যার নিরিখে মনসবগুলিকে বিভক্ত করা হয়েছিল— দহবাশী (দশকী অফিসার), বীসতী (বিংশতি), দো-বীসতী (চত্বারিংশতি), পঞ্জাহী (পঞ্চাশতি), সেহবীসী (ষষ্টি), চাহারবীসতী (অশীতি), নূজবাশী (নবতি), সদী (শতকী), পঞ্জসদী (পঞ্চ শতকী),
হাজারী, দো-হাজারী, সেহাজারী (তিনহাজারী), চারহাজারী, পঞ্জ-হাজারী (পাঁচহাজারী)। অমাত্যকে মনসব অনুসারে লোকজন ও সামরিক সাজ-সরঞ্জাম রাখতে হতো। পাঁচহাজারী মনসবদারের নিকট পাঁচ হাজার পদাতিক সৈন্য ছাড়াও ইরাকী, তুর্কি, তাজিকী ইত্যাদি জাতের ৩৩৭টি ঘোড়া, পাঁচ শ্রেণীর এক শত হাতি, মাল বহনের জন্য ৮০টি উট, ২০টি খচ্চর ও ১৬০খানা গরুর গাড়ি রাখা বাধ্যতামূলক ছিল।
এই খরচের জন্য তিনি আঠাশ হাজার থেকে ত্রিশ হাজার টাকা মাসিক বেতন পেতেন। এই ব্যবস্থা ছিল যাতে প্রয়োজন হলেই অবিলম্বে সৈন্যবাহিনী প্রস্তুত হয় এবং যেখানে প্রয়োজন সেখানেই দ্রুত পাঠানো যায়। কিন্তু অমাত্যরা মাইনের পয়সা পকেটে ভরে নামমাত্র সৈনিক ও ঘোড়া রাখত ।
যখন সৈন্য প্রয়োজনের খবর আসত, তাদের তারা এদিক-ওদিক দৌড়ঝাঁপ করে সৈন্যবাহিনী পূরণ করার চেষ্টা করত । পরিদর্শনের সময় দ্রুত অশ্বারোহী গজারোহী পদাতিক সৈন্য সংগ্রহ করে কুচকাওয়াজে প্রদর্শন করেই তাদের ছুটি দিয়ে দেওয়া হতো। এক জায়গায় ঘোড়া দেখানো হলেই সেগুলোকে আবার অন্য জায়গায় নিয়ে গিয়ে দেখানো হতো। এইরকম ফাঁকিবাজি অত্যন্ত বিপজ্জনক ছিল। এসব বন্ধ করার জন্যই ঠিক হয় ঘোড়ার গায়ে দাগ দেওয়া হবে। এই উদ্দেশ্যেই তো আজকাল ভোটদাতার আঙুলে কালির ছাপ দেওয়া হয় যাতে সে অন্য নামে দ্বিতীয়বার ভোট দিতে না পারে।
দাগ দেওয়ার ব্যবস্থাটাকে বড় থেকে ছোট কোনো অমাত্যই পছন্দ করত না, কারণ সেখানে পয়সার প্রশ্ন ছিল। এরূপ কঠোর ব্যবস্থার দায়ভার যে-ব্যক্তির উপর ছিল, লোকজন কি তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট থাকতে পারে? টোডরমলের মুশকিল ছিল এটাই ।
টোডরমল রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার সমস্ত রহস্য সম্পর্কে অভিজ্ঞ, হিসাব সংক্রান্ত বিষয়ে অতুলনীয় ছিলেন। তিনি মন্ত্রকের রীতি-নীতি, সাম্রাজ্যের আইন-কানুন, প্রজাদের হিতসাধন, দফতরে ব্যবস্থাপনা ঠিক-ঠাক রাখার গূঢ়তত্ত্ব জানতেন । কোষাগার পরিপূর্ণ রাখা, যাতায়াতের পরিবহণ-ব্যবস্থা বজায় রাখা, পরগণার রাজস্বের অঙ্ক সুনিশ্চিত করা, জায়গিরদারদের মাসহারা ও আমিরদের মনসবের নিয়ম টোডরমলই তৈরি করেছিলেন, তাঁর পরবর্তী সময়ে ইংরেজদের আগমন পর্যন্ত এবং কিছু কিছু তাদের রাজত্বকালেও চলেছিল । তাঁর কাজগুলি হলো—
১. প্রতিটি গ্রাম ও পরগণার রাজস্ব নির্ধারণ করা ।
২. পরিমাপের জন্য ব্যবহৃত ৫৫ গজের ফিতে শুকনো অথবা ভিজে হওয়ার দরুণ হ্রাস-বৃদ্ধি হতো। টোডরমল বাঁশ বা নকট দ্বারা নির্মিত ৬০ গজের মাপকাঠির প্রবর্তন করেন। জোড়ে জোড়ে লোহার কড়া পরানো হতো যাতে সংযোগস্থলে ফাঁক না পড়ে ।
৩. তাঁরই পরামর্শ অনুসারে ৯৮২ হিজরীতে (১৫৭৪-৭৫ খ্রিস্টাব্দে) সারা দেশকে বারোটি সুবায় বিভক্ত ও দশসালা বন্দোবস্তের প্রবর্তন করা হয়। কয়েকটি গ্রাম নিয়ে পরগণা, কতকগুলি পরগণা নিয়ে সরকার (জেলা) এবং কতকগুলি সরকার নিয়ে একটি সুবা গঠন করা হয়েছিল ।
৪. এক টাকা সমান চল্লিশ দাম স্থিরীকৃত হয়। দফতরে পরগণার খাজনা দাম-এ নির্ধারিত হতো।
৫. এক কোটি দাম-এর হিসেবে একজন আমিল (অমাত্য) নিযুক্ত করে তার নাম রাখা হয় করোড়ী ।
৬. আমিরদের (সেনাধ্যক্ষদের) নিজদের অধীনে বেতনভুক্ত সৈনিক রাখা বাধ্যতামূলক হয়। তাদের ঘোড়াদের জন্য দাগের নিয়ম জারি করা হয় যাতে এক জায়গার ঘোড়া দু-তিন জায়গায় নিয়ে গিয়ে দেখাতে না পারে এবং ঘোড়ার সংখ্যা কম হওয়ার ফলে ক্ষতি না হয় … ।
৭. বাদশাহের কর্মী-কর্মচারীদের সাতটি টোলায় ভাগ করে দেওয়া হয়েছিল। সপ্তাহের সাত দিন নিজের নিজের পালা অনুসারে প্রত্যেক টোলা থেকে লোক এসে চৌকিতে হাজিরা দিত ৷
৮. প্রত্যেকদিন এক-একজন চৌকিনওয়িস নিযুক্ত থাকত, তারা কাজে যোগ দিতে আসা কর্মী-কর্মচারীদের হাজিরা দিত। আবেদন-নিবেদন বিবেচনা করা, আদেশ জারি করা অথবা যথোপযুক্ত স্থানে পাঠানো তার কাজ ছিল ।
৯. প্রত্যেক সপ্তাহের জন্য সাত জন ওয়াকিয়া-নওয়িস (ঘটনা- লেখক) নিযুক্ত করা হতো, তারা দেউড়িতে বসে সারাদিনের বিবরণ লিপিবদ্ধ করত ।
১০. আমির ও খানদের ছাড়াও অতিরিক্ত চারহাজার এক্কা সওয়াব ছিল খাস শাহী প্রতিহার (গারদ), তাদের বলা হতো অহদী (এক্কা)। এদের জন্য পৃথক দারোগা (অমাত্য)-ও থাকত।
১১. আকবর কয়েক হাজার ক্রীতদাস অথবা যুদ্ধবন্দী দাস (গোলাম)-কে দাসত্ব থেকে মুক্ত করে দেন। তাদের বলা হতো চেলা। আকবরের বক্তব্য ছিল ঈশ্বরের সমস্ত বান্দাই মুক্ত, তাদের গোলাম (দাস) বলা অনুচিত…।
১২. ভারতের রাজা-বাদশাহরা ক্রয়-বিক্রয়, গ্রামাঞ্চলের ভূমি-রাজস্ব, কর্মী-কর্মচারীদের বেতন টাকায় হিসেব করতেন, কিন্তু দিতে হতো পয়সায়। ঢালাই- করা রূপোকে রূপোর টাকা বলা হতো যা রাজদূত ও নর্তকদের ইনাম দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হতো। তার সাধারণ চল ছিল না।
সেগুলো বাজারে রূপোর দরে বিক্রি হতো। টোডরমল মনসবদারদের ও রাজকর্মচারীদের বেতন টাকায় দেওয়ার প্রথা প্রচলন করেন এবং গ্রাম থেকে টাকায় রাজস্ব আদায়ের নিয়ম করেন। টাকার ওজন নির্দিষ্ট করা হয়েছিল এগারো মাসা। “তাতে চল্লিশ দাম ধরা হয়েছিল…।
কর্মী-কর্মচারীরা বেতন পেত টাকাতেই এবং সমস্ত গ্রাম, শহর, পরগণার রাজস্ব সরকারী দফতরে টাকার হিসেবেই লেখা হতো। এর নাম রাখা হয়েছিল আমল-নকদ-জমাবন্দি। ভূমি- রাজস্ব নির্ধারিত হয়েছিল এইরকম— বর্ষার জমিতে উৎপন্ন শস্যের অর্ধেক প্রজার বাকি অর্ধেক বাদশাহের । এই দ্বিতীয় ভাগের এক-চতুর্থাংশ খরচ ও ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যয় ধরে শস্যের এক-তৃতীয়াংশ বাদশাহ পেতেন ও দুই-তৃতীয়াংশ কৃষকেরা পেত।
ইক্ষু ইত্যাদিকে উচ্চ-ব্যয়বহুল শস্য বলা হতো। এই শস্য উৎপাদনের জন্য জল, যত্নাদি, শস্য-সংগ্রহ ইত্যাদির পরিশ্রম অন্যান্য শস্য অপেক্ষা বেশি প্রয়োজন, সেজন্য ক্ষেত অনুসারে উৎপন্ন শস্যের এক-চতুর্থাংশ, এক-পঞ্চামাংশ, এক-ষষ্ঠাংশ কিংবা এক- সপ্তমাংশের উপর বাদশাহের অধিকার ছিল, অবশিষ্ট প্রজার।…’ কর-আদায়, টোডরমলের মতো একজন রণনিপুণ সেনাধ্যক্ষ এবং যোগ্য প্রশাসকের উপর আকবরের বিশেষ পক্ষপাতিত্ব থাকা স্বাভাবিক ছিল।
চিতৌড় দখলে (ডিসেম্বর, ১৫৬৭ খ্রিঃ) একটি সুড়ঙ্গ ওড়ানোর দায়িত্ব পেয়েছিলেন টোডরমল। ১৫৭৩ খ্রিস্টাব্দে সুরাতে শত্রুপক্ষের শক্তি পরীক্ষার কাজ দেওয়া হয়েছিল তাঁকেই। ১৫৭৩ খ্রিস্টাব্দেই গুজরাতের ভূমি-রাজস্বের বন্দোবস্ত করেছিলেন তিনিই। গুজরাতের বিশৃঙ্খল শাসনব্যবস্থা ঠিক করার জন্য আকবর ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে সুবাদার করে সেখানে পাঠান।
টোডরমলকে এত দায়িত্বপূর্ণ কাজ দেওয়াতে অসন্তুষ্ট মুসলমান আমির বাদশাহের নিকটে অভিযোগ করেন : আপনি একজন হিন্দুকে মুসলমানদের উপরে বসিয়ে এত বেশি ক্ষমতা দিয়েছেন, এটা ঠিক নয়। উত্তরে আকবর বলেছিলেন— “হর কুদাম শুমা দর্-সরকারে-খুদ্ হিন্দুয়ে দারদ্। আগার মাহম হিন্দুয়ে দাস্তাহ্ ওয়াশীম্, চিরা আজ-ও- বদ বায়দ বৃদ্” (আপনারা প্রত্যেকেই আপনাদের কারবারে হিন্দু মুশী রাখেন । আমিও যদি হিন্দু রাখি, তাতে মন্দ কি হবে)।
আরও দেখুনঃ