রানা প্রতাপের সঙ্গে সঙ্ঘর্ষ , উদয়সিংহের সময় চিতৌড় তাঁর হাতের বাইরে চলে যায়। তারপর মোগল সাম্রাজ্য ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলে আবার তা রানাদের হস্তগত হয়। উদয়সিংহ রানা প্রতাপের মতো সুযোগ্য পুত্র লাভ করেছিলেন, তিনি ১৫৭২ খ্রিস্টাব্দে সিসোদিয়াদের সিংহাসনে বসেন । তিনি পূর্বপুরুষদের একঘেয়ে বীরগাথা ও সম্মান ব্যতীত আর কিছুই পাননি।
রানা প্রতাপের সঙ্গে সঙ্ঘর্ষ | বাংলা-বিহার বিজয় | আকবর
আকবর রাজপুতদের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করতে চেয়েছিলেন; আজমের, বিকানের, জয়সলমেরের প্রদর্শিত পথ সকলেই মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু মেওয়াড় কন্যাদানেও ইচ্ছুক ছিল না, নামমাত্র আনুগত্য স্বীকার করতেও সম্মত ছিল না।
আকবর চিতৌড়- বিজয়ের সময় রাজপুতদের শৌর্ষের পরিচয় পেয়েছিলেন। তিনি আরও নমনীয় শর্তে সিসোদিয়াদের সঙ্গে আপস করতেন, কিন্তু রানা সাঁগার উত্তরাধিকারী একটা পথই জানতেন— ম্লেচ্ছদের সঙ্গে আমাদের কোনো প্রকার মেলবন্ধনই হতে পারে না। আকবর ম্লেচ্ছ ছিলেন। আমির ও অন্যান্যরা নিজেদের কন্যাদান করে স্বধর্ম ত্যাগ করেছিলেন।
প্রতাপের পক্ষে তা করা সম্ভব নয়। ধীরে ধীরে রাজস্থানের প্রায় সমস্ত রাজাই মোগলদের কন্যা দান করেন। পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপনের অভিলাষ ছিল আকবরের। তিনি চাইতেন, রাজপুত রাজকুমারীরা নিজের নিজের ধর্ম নিয়ে মোগল মহলে থাকুন।
ধর্ম ব্যক্তিগত বিষয়, জাতি হিসেবে আমরা সবাই এক হব। ষোড়শ শতাব্দীর উত্তরার্ধে হিন্দুদের কাছে সেটা ছিল অত্যন্ত তিক্ত দাওয়াই। যদি সেই তিক্ত দাওয়াই সেদিন আমাদের দেশ পান করত, তাহলে সম্ভবত আমাদের ইতিহাস হতো অন্যরকম। যেসব রাজপুত নিজেদের কন্যা দান করেছিলেন মোগল শাহজাদাদের তাঁরাও এক অদ্ভুত ব্যাখ্যা প্রচার করেন— “আমরা শরীর থেকে দূষিত আঙুল কেটে ফেলে দিই।
আমাদের রক্ত মোগলে মিশতে পারে, কিন্তু মোগলের রক্ত আমাদের শরীরে প্রবেশ করতে পারেনি।” এরূপ ব্যাখ্যার কারণে যেসব রাজবংশ মোগলদের কন্যা দান করেছিল, সিসোদিয়াদের সঙ্গে তাঁদের সামাজিক সম্পর্ক বজায় থাকে।
প্রতাপের বীরত্ব ও ত্যাগের কথা ইতিহাসের পাতায় পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিখিত আছে। কিন্তু পৃথক পৃথক রাজবংশের মধ্যে দেশ ভাগ হয়ে থাকলে তাতে আমাদের দেশের কল্যাণ ছিল না। সমগ্র দেশকে একচ্ছত্র করার জন্য এই সব বংশগুলিকে উচ্ছেদ করা আবশ্যক ছিল, যেমন ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে করা হয়।
আমাদের এ কথা ভুললে চলবে না যে প্রতাপ একদিকে কুল ও ধর্মের আত্মাভিমানে নিজেদের ছারখার করে দেওয়া বীর ছিলেন, অন্যদিকে তিনি সেই মতাদর্শের প্রতীক ছিলেন, যা দেশকে শত শত খণ্ডে খণ্ডিত করার পক্ষপাতী।
প্রায় এক-চতুর্থাংশ শতাব্দী (১৫৭২-৯৭ খ্রিঃ) জুড়ে প্রতাপ আকবরের প্রবল শক্তির মোকাবিলা করেন। সাম্রাজ্যের কোনো-না-কোনো অংশে ক্ষোভ-বিক্ষোভে আকবরকে ব্যতিব্যস্ত থাকতে হতো। সেই সময় প্রতাপ তার সাহসী যোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে আড়াওয়ালা পার্বত্য উপত্যকা থেকে বেরিয়ে মোগল শাসিত ভূ-খণ্ডে হামলা চালাতেন। শত্রু-সৈন্যের সংখ্যা বেশি দেখলে তিনি আড়াওয়ালা পাহাড়-পর্বতে ও তার জঙ্গলে আশ্রয় নিতেন। প্রতাপ হন্যে হয়ে ঘোরেন, তার সন্তান- সন্ততিরা জঙ্গলে ফলমূল আহার করে দিনাতিপাত করে। কুম্ভলনের, গোগুণ্ডা ইত্যাদি পাহাড়ী দুর্গ মজবুত করেন তিনি।
এই সঙ্ঘর্ষের কারণে বনাস ও বেরিস উর্বর উপত্যকা শ্মশানে পরিণত হয়। সে সময় প্রতাপের রাজ্য নতুন রাজধানীর (উদয়পুরের) পশ্চিমে কুম্ভলনের থেকে রিকমনাথ পর্যন্ত আশি মাইল দীর্ঘ এবং মীরপুর থেকে সিতৌলা পর্যন্ত ততটাই প্রশস্ত ছিল। মানসিংহ প্রতাপকে বোঝাবার চেষ্টা করেন। প্রতাপ অদ্ভুতের মতো তার সামনে থালা রাখতে বলেন, একসঙ্গে আহারে বসার পরিবর্তে অপমানজনক শব্দ ব্যবহার করেন।
মানসিংহ থালা থেকে দু’টো দানা তুলে পাগড়িতে রাখেন এবং মেওয়াড় উচ্ছেদের প্রতিজ্ঞা করে রওনা হন। ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দের সমরাভিযানে আকবর প্রতাপকে হত্যা করে মেওয়াড়কে নিজের সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে নিতে চেয়েছিলেন ।
হলদিঘাটী (১৫৭৬ খ্রিঃ)— আকবর ইতিমধ্যে বাংলায় পাঠান-শক্তি খর্ব করতে প্রায় সফল হয়েছিলেন। এবার তার নজর পড়ল প্রতাপের উপর। সলীমকে শোভমান করে মানসিংহের নেতৃত্বে এক বিশাল সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হল মাঁডলগড়ে (বুঁদি ও চিতৌড়ের মধ্যে অবস্থিত)। শাহী সেনার লক্ষ্য মাঁডলগড় থেকে এক শত মাইল দূরে অবস্থিত গোগুণ্ডার (দক্ষিণ আড়াওয়লা) শক্ত পাহাড়ী দুর্গ। হলদিঘাটী যুদ্ধের তিনি বছর পূর্বে ৯৮১ হিজরীতে (১৫৭৩-৭৪ খ্রিঃ) খাজা গিয়াসুদ্দীন কজওয়িনীকে আসফ খাঁ উপাধি দেওয়া হয়েছিল।
রানী দুর্গাবতীর বিরুদ্ধে বিজয়ী আব্দুল আজীজ আসফ খাঁ নন, ইনি অন্য এক আমির। গোগুণ্ডা যাওয়ার জন্য তাঁকে তেরো-চোদ্দ মাইল দূরে হলদিঘাটী (হলদিভাড়া) অতিক্রম করতে হবে। রানা তাঁর তিন হাজার সওয়ার সহ এই ঘাটীতেই শাহী সেনাকে আক্রমণ করবেন বলে মনস্থির করেন।
টডের বর্ণনায়— “এই ঘাটীতে মেওয়াড়েরা তৈরি হয়ে ছিল, যাদের একটি স্মরণীয় সংগ্রাম করতে হবে। এক বংশের পর আর এক বংশ নিজেদের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে তাদের রানার বীরত্ব অনুকরণ করার জন্য তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু করে। তীব্রতম সঙ্ঘর্ষের মাঝখানে প্রতাপের সঙ্গে লাল পতাকা উড়তে থাকে পত্পত্ করে। কিন্তু সেই দুর্দমনীয় বীরত্ব আকবরের বহু কামান ও অগুনতি সেনার সম্মুখে অর্থহীন হয়ে যায়। বাইশ হাজার রাজপুত সেদিন হলদিঘাটী রক্ষার জন্য জড়ো হয়েছিল, তার মধ্যে মাত্র আট হাজার জীবিতাবস্থায় যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফেরে।”
জানুয়ারিতে ঘাটের মুখেই খম্ওয়র গ্রামের কাছে এই সংগ্রাম হয়। বিধর্মীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে গাজী হওয়ার লোভে ঐতিহাসিক বদায়ূনী বিশেষ আগ্রহের সঙ্গে এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন, তিনি হলদিঘাটী যুদ্ধের প্রত্যক্ষ বিবরণ দিয়েছেন। সেদিন শরীর পুড়িয়ে দেওয়া রোদ ছিল, সেই সঙ্গে বইছিল তপ্ত লু-হাওয়া, তাতে মানুষ দরদর করে ঘামছিল।
বদায়ূনী তাঁর সর্দার আসফ খাকে জিজ্ঞাসা করেন— “এই তীব্র সঙ্ঘর্ষপূর্ণ লড়াইয়ে আপনি শত্রু ও মিত্র রাজপুত্র আলাদা করে চিনবেন কিভাবে?” আসফ খা জবাব দিলেন— “রাজপুত যে পক্ষেরই হোক, মরলে ইসলামেরই লাভ।” বদায়ূনী খুব সন্তোষ প্রকাশ করে লিখেছেন, চিতৌড়ের বীর জয়মলের পুত্র প্রাণত্যাগ করে দোজখে গেলেন।
মোগল-পক্ষে দেড় শত মুসলমান এবং বহু হিন্দু নিহত হয়। মনে হচ্ছিল, আকবরী সেনাকে হয়তো প্রচণ্ড ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করতে হবে। এমন সময় প্ৰতাপ আহত হন। রানার প্রভু-ভক্ত ঘোড়া চেতক প্রভুকে নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করে। চেতক নিজের প্রাণ দিয়ে প্রভুকে বাঁচায়। তখন মোগল-সেনার আর সেই উদ্যম ছিল না যে শত্রুর পিছু ধাওয়া করে। সেজন্য আকবর মানসিংহের উপর একটু অসন্তুষ্ট হন। রানার বিখ্যাত হাতি সিক্রীতে নিয়ে যাওয়ার ভার দেওয়া হয় বদায়ূনীকে, সে-কথা আমরা আগেই বলেছি।
প্রতাপ আরও দূরে চওয়ণ্ডে সরে যেতে বাধ্য হন। কিন্তু পরে নিজের জীবনকালেই তিনি চিতৌড়, আজমের ও মাডলগড় বাদে সারা মেওয়াড় নিজের অধিকারে নিয়ে এসেছিলেন এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত সুরক্ষার জন্য আকবরকে পাঞ্জাবেই আটকে রেখেছিলেন, আকবর কিছুই করতে পারেননি।
১৫৯৭ খ্রিস্টাব্দে প্রতাপ পরম যশস্বী বীর হিসেবে দেহত্যাগ করেন। তিনি তাঁর উত্তরাধিকারী পুত্র অমরসিংহকে এই উপদেশ দিয়েছিলেন যে সিসোদিয়ার পতাকা যেন কোনোদিন নিচু না হয়। মোগল ঐতিহাসিক প্রতাপের বীরত্বকে ভর্ৎসনার দৃষ্টিতে দেখেছেন, কিন্তু ভিনসেন্ট স্মিথের কথায়— “এই নরনারী ও স্মরণীয় হওয়ার যোগ্য, বরং পরাজিত বিজেতা অপেক্ষাও মহান।”
আরও দেখুনঃ