Site icon History Gurukul [ ইতিহাস গুরুকুল ] GDCN

শ্রেষ্ঠ শাসক মানসিংহ  | মানসিংহ | আকবর

শ্রেষ্ঠ শাসক মানসিংহ  | মানসিংহ | আকবর

শ্রেষ্ঠ শাসক মানসিংহ, বিহারের রাজ্যপাল— ১৫৮৭ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর বিহারের জন্য মানসিংহের প্রয়োজন হয়। আকবর তাঁকে হাজীপুর-পাটনার শাসনভার দিয়ে প্রেরণ করেন। সুরাপান আসরে খানখানা, মানসিংহ ও অন্যান্য আমিরেরাও উপস্থিত ছিলেন। আকবর মানসিংহকে দীন-ইলাহীতে যোগ দেওয়ার জন্য ইঙ্গিত করেন।

শ্রেষ্ঠ শাসক মানসিংহ  | মানসিংহ | আকবর

 

 

মানসিংহ বলেন— “আমি হিন্দু। যদি আপনার আদেশ হয়, তাহলে আমি মুসলমান হতে পারি, কিন্তু এই দুই ধর্মের বাইরে আমি আর কোনো ধর্ম জানিনে।” বদায়ূনী লিখেছেন : ব্যাপারটা সেখানেই মিটে গিয়েছিল। বাদশাহ আর কোনো কথা বলেননি, তাঁকে বাংলায় পাঠিয়ে দেন। বিহারের প্রধান শহর হাজীপুর ও পাটনা গঙ্গার এপার-ওপার ছিল।

কিন্তু জানা যায়, মানসিংহ হাজীপুরে ও গণ্ডকের এপারে শোনপুরে বেশি সময় থাকতেন। আজও সেখানে তার চিহ্ন রয়েছে : শোনপুরের কাছে ‘রাজা মানসিংহের গড়’, ‘বাগ-রাজা মানসিংহ’, ‘মোগলওয়াড়ী’। “নারায়ণীর তীরে চক আবু সঈদ মৌজার উঁচু ঢিবিকে বলা হয় মানসিংহের গড়। লোকে বলে, মোগল আমলে এই স্থান রাজা মানসিংহের গড় ছিল। সেখানে আজও গড়ের বড় বড় পাথর ও ইটের তৈরি চূড়া সে কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। কিছুদিন থেকে এই গড়কে বলা হচ্ছে কিলু বাবার গড়। লোকে বলছে, কিন্তু বাবা চক আবু সঈদ মৌজা দখল করে নিজের গৃহ নির্মাণ করেছিলেন ।

এদিকে “এই মৌজায় একটি গুপ্তধনের কূপ রয়েছে, এ সম্পর্কে এখানকার মানুষের বিশ্বাস, এই কৃপ, অগাধ ধনরাশিতে পূর্ণ। আরও বলা হয়, এই কূপে আজও একটি বিশাল সাপ থাকে । … “সরকারী নথিপত্রে… কট্‌হরিয়ার নিকটে যে হাতিয়ার তথা বাগান ইত্যাদি রয়েছে, তা আজও রাজা মানসিংহের নামে বিখ্যাত । সেই বাগানে আজও কূপ রয়েছে, তার অভ্যন্তরের পাথরে রাজা মানসিংহের নাম খোদিত আছে ।

“মোগলওয়াড়ী হরিহরনাথের পশ্চিম সংলগ্ন। মোগলওয়াড়ীর ধ্বংসাবশেষ আজ আর পাওয়া যায় না। মানুষ বিশ্বাস করে যে যদি ওই স্থানে খননকার্য চালানো হয়, তাহলে মোগল আমলের কিছু সামগ্রী পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।”

মানসিংহের শাসনকাল বিহারে সুখ ও সমৃদ্ধির যুগ ছিল । তিনি সেখানে বহু গড় ও নানা অট্টালিকা নির্মাণ করিয়েছিলেন, মন্দিরে ভূমিদান করেছিলেন। সেখানে কিছু দানপত্র এখনও পাওয়া যায় । ১৫৮৯ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বরে লাহৌরে রাজা ভগবানদাসের মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুর পর কুমার মানসিংহ রাজা মানসিংহ হন, সেই সঙ্গে শাহী দরবারে সবচেয়ে বড় মনসব (পদ) পঞ্জহাজারী লাভ করেন ।

মানসিংহের মতো সিদ্ধহস্ত সৈনিক শুধুমাত্র শাসনকার্যে রত থেকে কি করে সন্তুষ্ট থাকতে পারেন, বিশেষ করে তখন, যখন তাঁর তরবারি যাতে কোষবদ্ধ না রাখতে দেওয়ার জন্য বাংলা ও ওড়িশায় পাঠানরা চেষ্টা চালাচ্ছে। ওড়িশায় প্রতাপদেবকে বিষপ্রয়োগ করে তাঁর পুত্র নরসিংহদেব সিংহাসন হস্তগত করেন। কিন্তু খুব শীঘ্রই তাঁকে প্রাণ হারাতে হয়। বাংলার পাঠান-নেতা সুলেমান কিরানী ওড়িশার এই পরিস্থিতির সুযোগে সেখানে নিজের আধিপত্য কায়েম করেন। কত খাঁ ও অন্যান্য আফগানরা (পাঠানরা) নিজেদের প্রতাপ জাহির করতে লাগেন। মানসিংহ বেশ ভালো সুযোগ পেয়ে যান ।

সাধারণত দশহরার পর বর্ষা শেষ হলেই সামরিক অভিযান উত্তম বলে মনে করা হতো, কিন্তু আকবর সেই প্রথা মানতেন না। মানসিংহও বর্ষাকালটাকেই পছন্দ করলেন। তিনি তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্রের সঙ্গে সৈনবাহিনী নিয়ে ওড়িশা অভিমুখে অগ্রসর হলেন। মানসিংহ স্বয়ং অগ্রগামী বাহিনীর সঙ্গে থাকেন। দৈবক্রমে সেই সময় কত খাঁর মৃত্যু হয়। আফগানদের মধ্যে কলহ-বিবাদ শুরু হয়ে যায়। বহু পাঠান মানসিংহের সঙ্গে যোগদান করে। বাকি পাঠানরা আপস করে নেওয়াই মঙ্গল বিবেচনা করে আকবরকে তাদের সম্রাট বলে স্বীকার করে নেয়।

মানসিংহ দেড় শত হাতি দরবারে প্রেরণ করেন। বহুমূল্য উপঢৌকন-সহ কিন্তু আফগানরা এই আপস বেশিদিন মেনে চলতে রাজি হয়নি। তারা প্রথমে পুরী-ওড়িশা নিজেদের আয়ত্তাধীন করে বাদশাহী এলাকাতেও আক্রমণ শুরু করে। মানসিংহের তো একটা অজুহাত প্রয়োজন ছিল। এক বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে মানসিংহ স্বয়ং গঙ্গাপথে যাত্রা করেন, অন্যান্য সেনাধ্যক্ষদের ঝাড়খণ্ডের পথে প্রেরণ করেন। পাঠানরা আপস করার ইচ্ছা প্রকাশ করে, কিন্তু মানসিংহ তাদের কথা শুনতে আদৌ রাজি হলেন না।

শেষে তারা সাহস সঞ্চয় করে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়, তবে পরাজয় ব্যতীত কিছুই তাদের লাভ হয় না। মানসিংহ আকবরের সাম্রাজ্যের সীমা পুরীর সমুদ্রতট পর্যন্ত বিস্তৃত করে দেন। হাজীপুর-পাটনা শাসন কেন্দ্র হওয়ার উপযুক্ত ছিল না, সেজন্য তিনি রাজধানী আকমহলে নিয়ে যান, তার নাম দেন আকবরনগর, কিন্তু তা প্রসিদ্ধ হয় রাজমহল নামে। সাঁওতাল পরগণায় এখন সেটা একটা ছোট শহর, উত্তরে প্রবাহিত গঙ্গা স্থানটিকে একটি সামরিক গুরুত্বপূর্ণ উপত্যকার রূপ দিয়েছিল। ঔরঙ্গজেবের আমল পর্যন্ত রাজমহল ছিল বাংলার রাজধানী।

১৫৯২ খ্রিস্টাব্দ এবং পর্যন্ত মানসিংহ বাংলা-বিহারের ভাগ্যবিধাতা হয়ে থাকেন— যদিও তিনি অধিকাংশ সময় কাটাতেন আজমেরে। ১০০২ হিজরীতে (১৫৯৩-৯৪ খ্রিস্টাব্দে) আকবর তাঁর পৌত্র ছয় বৎসর বয়স্ক খুসরোকে পঞ্জহাজারী মনসব দিয়ে ওড়িশা জায়গির দেন। মানসিংহ তাঁর ভাগিনেয়র আতালীক (তত্ত্বাবধায়ক গুরু) নিযুক্ত হন এবং জায়গিরের তত্ত্বাবধানও করতে থাকেন।

ওই সময়েই কোচবিহারের রাজা বাদশাহের অধীনতা স্বীকার করেন। সে-সময় পূর্ব ভারতে তিনি ছিলেন সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী রাজা। তাঁর চার লক্ষ অশ্বারোহী সৈন্য, দুই লক্ষ সেপাই, সাত শত হাতি এবং এক হাজার সামরিক নৌকো যুদ্ধের জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকত ।

১০০৫ হিজরীতে (১৫৯৬-৯৭ খ্রিস্টাব্দে) মানসিংহের পুত্র জগৎসিংহকে পাঞ্জাবের পার্বত্যাঞ্চলের শাসক নিযুক্ত করা হয়। মানসিংহের আর এক পুত্র হিম্মতসিংহ এই সময় প্রাণত্যাগ করেন, তাঁর যোগ্যতা বিষয়ে পিতার বড় গর্ব ছিল । এই বছরই বাংলায় ঈসা খাঁ আফগান বিদ্রোহ করেন। মানসিংহ তাঁর পুত্র দুর্জনসিংহকে সেনা-সহ পাঠিয়ে দেন। পাঠানেরা প্রতারণা করে দুর্জনসিংহকে হত্যা করে ।

১০০৬ হিজরীতে (১৫৯৮-৯৯ খ্রিস্টাব্দে) মধ্য-এশিয়ার খান আব্দুল্লার মৃত্যু-সংবাদ শুনে আকবর পিতৃ-পিতামহের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার কথা ভাবেন এবং পূর্বপুরুষদের ভূমি নিজের হস্তগত করতে মনস্থ করেন। কিন্তু দাক্ষিণাত্যের বাহমনী রাজ্যগুলিও অধিকার করার গরজ ছিল তাঁর।

তিনি শাহজাদা দানিয়ালের সঙ্গে আব্দুর রহীম খানখানা ও আবুল ফজলকে দাক্ষিণাত্যের যুদ্ধের প্রেরণ করেন। পরে তাঁদের সাহায্য করার জন্য স্বয়ং তাঁকেও যেতে হয়েছিল। রানা প্রতাপকেও তিনি তখনও বিস্মৃত হতে পারেননি। জাহাঙ্গিরকে একটি বড় সেনাবাহিনী দিয়ে সেদিকে পাঠান সেই সেনাবাহিনীর সর্বেসর্বা ছিলেন মানসিংহ।

রানাকে তিনি নিজের চরম শত্রু বলে মনে করতেন । বাংলার সুবেদারি মানসিংহের পুত্র জগৎসিংহকে দেওয়া হয়েছিল। তিনি যাত্রার জন্য আগরায় প্রস্তুত হচ্ছিলেন, আকস্মিকভাবে তাঁর মৃত্যু হয়। এর ফলে জগৎসিংহের পুত্র মানসিংহকে পিতার স্থানে নিযুক্ত করা হয়। মানসিংহকে আফগানদের কঠিন মোকাবিলার সম্মুখীন হতে হয়, বাদশাহী সেনাকে পরাজয় স্বীকার করতে হয়। বাংলায় আবার পাঠানদের রমরমা চলতে থাকে। সলীমের মনোবৃত্তি ছিল আরাম-আয়েশে সময় কাটানো। উদয়পুরের পাহাড়ে

পাহাড়ে ঘুরে-ফিরে রানা যুদ্ধ করছিলেন। সেই প্রস্তরাকীর্ণ অঞ্চলে গমনাগমন সলামের পছন্দসই ছিল না। তিনি যুদ্ধ বন্ধ করে দিলেন এবং সৈন্য নিয়ে বাংলার দিকে রওনা দিলেন। তাঁর মনে অন্য কোনো অভিসন্ধি ছিল। আগরায় পৌছলেন। তার প্রিয় পিতামহী মরিয়ম মাকানীকে সালাম জানাতেও গেলেন না।

পিতামহীর কিছু সন্দেহ হল। তিনি নিজে গিয়ে দেখা করতে চাইলেন, কিন্তু সলীম নৌকোয় চড়ে প্রয়াগের দিকে রওনা হয়ে গেলেন। সেখানে পুনরায় সেই একই আরাম-আয়েশ শুরু হল। কিন্তু প্রয়াগে আরাম-আয়েশেই সন্তুষ্ট হলেন না তিনি, বরং পিতার বিদ্রোহের উদ্যোগ নিলেন। আকবরের সন্দেহ হল, হয়তো এর পিছনে মানসিংহেরও হাত আছে।

 

 

জগৎসিংহের পুত্র মানসিংহের অসাফল্য ও পাঠানদের বিদ্রোহের কথা শোনামাত্র মানসিংহ সেদিকে ধাবিত হলেন। পূর্ণিয়া, বিক্রমপুর, যেখানে যেখানে পাঠানরা বিদ্রোহের নিশান উড়িয়েছিল, সেসব জায়গায় নিজের সেনা পাঠান, নিজেও যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। সব জায়গায় পাঠানদের দমন করে তিনি ঢাকায় গিয়ে পৌঁছান শাসনকার্য পরিচালনা করতে থাকেন। তখন মানসিংহের উপর বাদশাহের সন্দেহ দূর হয়ে গিয়েছিল। এইসব যুদ্ধে পর্তুগিজ ও ডাচ সেপাইরাও পাঠানদের সঙ্গে যোগদান করেছিল । ভারতের যুদ্ধে ইউরোপীয়দের সেই প্রথম অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়। এবং

আকবর জানতেন, যোগ্য ব্যক্তি তাঁর তখতে বসলে তবেই সে তাঁর সাফল্যগুলিকে আরও সফলতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে। সলীম যে সম্পূর্ণ অযোগ্য, তা ইতিমধ্যেই সাব্যস্ত হয়ে গিয়েছিল, সেই কারণে আকবর কখনো কখনো মনের মধ্যে এই ইচ্ছা পোষণ করতেন যে পুত্রের বদলে পৌত্র খুসরোকে উত্তরাধিকারী করবেন। খুসরো রাজা মানসিংহের ভাগিনেয় এবং রাজ্যের একজন খুব বড় আমির খানে-আজম আজীজ কোকার জামাতা। এই দু’জন ব্যক্তি যদি খুসরোকে বাদশাহ হিসেবে দেখতে চান, তাতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই।

১০১৩ হিজরীতে (১৬০৪-৫ খ্রিস্টাব্দে) আকবর খুসরোকে দশহাজারী মনসব প্রদান করেন এবং মানসিংহকে সাড়ে সাতহাজারী মনসবের পদ দিয়ে তাঁর পৌত্র ভাউসিংহকেও একহাজারী মনসব প্রদান করেন। তখনও পর্যন্ত পাঁচহাজারীর উপর মনসব কোনো আমির পাননি। মানসিংহই প্রথম, যিনি সাড়ে সাতহাজারী হন। তাঁকে বাংলায় যাওয়ার আদেশ হলে তিনি খুসরোকে সঙ্গে নিয়ে বাংলা রওনা হন। তাঁদের অনুপস্থিতিতে ১৬০৫ খ্রিস্টাব্দের ২৭শে অক্টোবর আগরায় আকবর প্রাণত্যাগ করেন। আকবর মৃত্যুশয্যায় শুয়ে শুয়েই সলীমকে তাঁর উত্তরাধিকারী ঘোষণা করে দেন। সলীমের সমর্থকের সংখ্যাও কম ছিল না ।

শাহজাদা সলীম জাহাঙ্গির নাম ধারণ করে মোগল-সিংহাসনে আরোহণ করেন। নিজের মাতুল-পুত্র মানসিংহের বিরুদ্ধে তাঁর অভিযোগ ছিল, কিন্তু তা আর না ভেবে তাঁকে বাংলার নিজের পক্ষের সুবাদার নিযুক্ত করেন। কয়েক মাস পরে খুসরো বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন। অবশ্য তার জন্য মানসিংহের উপর ক্রোধ প্রকাশ করা সমীচীন বোধ করেননি জাহাঙ্গির। সিংহাসনে বসার এক বছর আট মাস পরে তিনি স্বয়ং লিখেছেন— “রাজা মানসিংহ পাটনা মুলুকে অবস্থিত রোহতাস দুর্গ থেকে এসে দরবারে হাজির হলেন।

ছয়-সাতটি আদেশ পাঠানোর পর তবেই এলেন। খানে আজমের মতো তিনিও একজন ধনলিপ্সু পুরনো পাপী। তিনি আমার সঙ্গে কি ব্যবহার করেছেন এবং আমি তাঁর সঙ্গে কি ব্যবহার করেছি, তা ঈশ্বরই জানেন। কোনো ব্যক্তিই কারো সঙ্গে তাঁর মতো এরকম আচরণ করতে পারে না। রাজা মদ্দা ও মাদী মিলিয়ে এক শত হাতি ভেট দিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে এমন একটিও নেই যেটাকে উৎকৃষ্ট হাতির মধ্যে রাখা যেতে পারে।

আমার পিতার হাতে তৈরি যুবকদের মধ্যে তিনি একজন। তাঁর নানা অপরাধের কথা মুখেও আনিনি, বাদশাহী অনুগ্রহে তাঁর মঙ্গলই করেছি।” দুই মাস পরে তিনি পুনরায় লিখেছেন— “আমার সমস্ত ঘোড়ার মধ্যে একটি ঘোড়া ছিল শ্রেষ্ঠ। আমি দয়াপরবশ সেটি মানসিংহকে দিলাম। তিনি আহ্লাদে এমন আটখানা হয়ে উঠলেন যে তাঁকে সাম্রাজ্য দিলেও বুঝি তিনি এত খুশি হতেন না । ”

মানসিংহ ভবিতব্যের কাছে মাথা নত করেছিলেন এবং জাহাঙ্গিরের শাসনাধিকার মন থেকে মেনে নিয়েছিলেন। তবুও খুসরোর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক থাকার কারণে জাহাঙ্গিরের মন থেকে সন্দেহ দূর হয়নি। মানসিংহ সাব্যস্ত করার চেষ্টা করেছিলেন যে তিনি যেমন পিতার অনুরক্ত ছিলেন তেমনি পুত্রেরও। সেজন্য বাংলা থেকে ফিরে এসে দাক্ষিণাত্যের যুদ্ধে যাওয়ার জন্য অনুমতি গ্রহণ করেন। ১০২১ হিজরীতে (১৬১২-১৩ খ্রিস্টাব্দে) তিনি তাঁর সেনা নিয়ে দাক্ষিণাত্যে পৌঁছান এবং সেখানে ১০২৩ হিজরীতে (১৬১৪ খ্রিস্টাব্দে) তাঁর মৃত্যু হয়। যদিও নিয়মানুসারে আমেরের রাজপদ মানসিংহের জ্যেষ্ঠ পুত্র জগৎসিংহের পুত্র মানসিংহের পাওয়ার কথা, কিন্তু জাহাঙ্গির মানসিংহের জীবিত পুত্রদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা জ্যেষ্ঠ ভাউসিংহকে মির্জা রাজা পদবির সঙ্গে চারহাজারী মনসব প্রদান করে আমেরের গদিতে আসীন করেন।

আকবরের সবচেয়ে বড় সেনাপতি ছিলেন মানসিংহ, আব্দুর রহীম খানখানা ও খানে-আজম (মির্জা-আজীজ)। জাহাঙ্গিরের শাসনকালে খানখানা ও খানে-আজমকে খুবই অপমানকর জীবনযাপন করে প্রাণত্যাগ করতে হয়। মানসিংহের উপরেও কালো ঘনঘটার ছায়া পড়েছিল, কিন্তু তিনি তা থেকে নিজেকে মুক্ত করে চলে যেতে পেরেছিলেন।

মানসিংহ অত্যন্ত উদার, মধুর-প্রকৃতি ও মিশুকে স্বভাববিশিষ্ট ছিলেন। একবার খানখানা (রহীম) ও মানসিংহ দাবা খেলছিলেন। শর্ত ছিল, খেলায় যিনি হারবেন, তাঁকে জানোয়ারের ডাক ডাকতে হবে। খানখানা ক্রমশ কোণঠাসা হচ্ছিলেন। মানসিংহ হাসতে শুরু করলেন। বললেন— তোমাকে বিড়ালের ডাক ডাকাব ।

খানখানা সাহস করে দু’চারবার ঘুঁটি চাললেন। তারপর যখন দেখলেন আর কোনো আশা নেই, তখন চলে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালেন— “অয়্ হা, আজ খাতিরম্ রফ্‌তাঃ-বুদ্, হালা ইয়াদম্ আমদ্। বিরওয়ম্ কি জূতর্ সর্-অঞ্জমশ্ কুনম্” (ওহো, একদম মনে ছিল না। ভালোই হল, মনে পড়েছে। যাই, তাড়াতাড়ি কাজটা সেরে ফেলি)। মানসিংহ বললেন— “ন মি-শওয়দ্।… সদায়ে পিক্ ব-কুনীদ্ ওয়া বিওঈদ্” (হতে পারে না ।

যেতে হলে বিড়াল ডেকে যাও)। তাতে খানখানা বলে উঠলেন “শুমা দামনম্ ব- গুজারীদ, মী-আয়ম্” (তুমি আমার জামা ছেড়ে দাও, আমি আসছি, আমি আসছি)। ‘মী-আয়ম্” (আমি আসছি) কথাটাকে তিনি ‘মিয়াউ’-এর মতো উচ্চারণ করাতে মানসিংহ হেসে ফেললেন।

আর একটা খোশগল্প বলা যাক । বাংলায় কোনো এক ফকিরশাহ দৌলতের খ্যাতি শুনে তাঁকে দর্শন করতে গিয়েছিলেন মানসিংহ। তার কথাবার্তায় খুশি হয়ে শাহ সাহেব বললেন— “মানসিংহ, আপনি মুসলমান হচ্ছেন না কেন?” মানসিংহ মৃদু হেসে জবাব দিলেন— “খমাঃ-আল্লাহু অলা-কুলুবেহিম” (আল্লাহ আমার অন্তরে সীলমোহর করে দিয়েছে)। অর্থাৎ আল্লা যখন সীলমোহর করে দিয়েছে, তখন আমি কেন তা ভেঙে ফেলার দোষ করব?

মানসিংহ, খানখানা ও খানে-আজম— তিনজনই আকবরের অত্যন্ত প্রিয়পাত্র ছিলেন। তৈমূর নিজে আমির পদবি গ্রহণ করেছিলেন। তিনি খান, সুলতান অথবা শাহ হননি। তৈমূরী শাহজাদাদের মির্জা-আমিরজাদা বলা হতো। অত্যন্ত সম্মানজনক শব্দ ছিল মির্জা। আকবর খানখানাকে মির্জা খা, খানে-আজম আজীজকে মির্জা আজীজ এবং মানসিংহকে মির্জা রাজা বলে সম্বোধন করতেন । মানসিংহ বাদশাহের পরিবারেরই একজন ছিলেন ।

মানসিংহের বাস্তুশিল্প-প্রীতি ও ধর্মপ্রীতির মূর্ত দৃষ্টান্ত বৃন্দাবনের গোবিন্দ দেব মন্দির। দিল্লীবাসী বাস্তু-শাস্ত্রবিদ গোবিন্দদাস সেটি পাঁচতরা তৈরি করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তা অসমাপ্তই থেকে যায়, তবুও একজন অভিজ্ঞ ইংরেজ গ্রাউস বলেছেন— “হিন্দুশিল্প-কীর্তিতে এটি অত্যন্ত প্রভাব বিস্তারকারী, অন্তত উত্তর ভারতে।” শাহজাহান যে-জায়গায় উপর র তাজমহল নির্মাণ করেছেন, সেই জায়গাটি ছিল মানসিংহের ৷

 

 

আজ থেকে চার শত বছর পূর্বে আমাদের পূর্বপুরুষেরা এক মহান কাজের ভার নিজেদের মাথার উপর তুলে নিয়েছিলেন। তাঁদের সাফল্য ক্ষণস্থায়ী প্রতিপন্ন হয়েছে, কিন্তু তাতে তার গুরুত্ব কমে যায় না। তাঁরা একটা কিছু করতে চেয়েছিলেন, তার সমস্ত ব্যাপার তাঁদের কাছে স্পষ্ট ছিল না, তবে তাঁরা অবশ্যই জানতেন; সমস্ত মানুষকে একজাতিতে পরিণত করতে হবে, সংস্কৃতিকে এক করে অশন-বসন-কন্যাদানে শুচিবায়ু ত্যাগ করতে হবে। মানসিংহ সেই একজাতি নির্মাণের একজন অগ্রপথিক।

বহুদিন পর্যন্ত তাঁকে বিভীষণ বলা হয়েছে, কিন্তু সমগ্র দেশকে এক রাষ্ট্র ও একজাতিতে পরিণত করার স্বপ্ন দেখেছিলেন যিনি, তিনি বিভীষণ হতে পারেন না। প্রতাপ আত্মোৎসর্গের জন্য চিরকাল প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে থাকবেন, কিন্তু প্রতাপের আদর্শ যদি আজও অক্ষুণ্ণ থাকত, তাহলে মেওয়াড় ভারত প্রজাতন্ত্রের অঙ্গ হতো না।

আরও দেখুনঃ

Exit mobile version