সরকারী অমাত্য – নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “আকবর” বিষয়ের “শাসনব্যবস্থা” বিভাগের একটি পাঠ। অমাত্য ও মনসবদের বিষয়ে আগেও এখানে-ওখানে কিছু কিছু উল্লেখ করা হয়েছে, এখানে সে-সম্বন্ধে একসঙ্গে বিবৃত করা হল-
Table of Contents
সরকারী অমাত্য
(১) সিপাহসালার আকবরের শাসনব্যবস্থা ছিল সামরিক। সারা জীবন যাঁকে যুদ্ধে কাটাতে হয়েছিল, তাঁর পক্ষে সেটাই ছিল স্বাভাবিক। প্রত্যেক সুবার শাসক বা রাজ্যপালকে বলা হতো সিপাহসালার (জেনারেল বা ফিল্ড মার্শাল)। তাঁকে সহায়তা করার জন্য বাদশাহের পক্ষ থেকে নিয়োগ করা হতো ১. দীওয়ান (অর্থ-সচিব), ২. বখ্শী (সামরিক অর্থ-সচিব), ৩. মীর-অদল (সেশন জজ), ৪. সদর (ধর্ম-বিভাগীয় সচিব), ৫. কোতওয়াল (পুলিশ ইনস্পেক্টর-জেনারেল), ৬. মীরূবহর (জল-বিভাগীর সচিব), এবং ৭. ওয়াকিয়া নওয়িস (অভিলেখ-রক্ষক)। তাঁদেরকে সিপাহসালারের পছন্দ হবে কেন? তাঁরা তো বাদশাহের লোক ।
(২) ফৌজদার—
সরকারের (জেলার) সর্বোচ্চ পদাধিকারীকে (জেলা ম্যাজিস্ট্রেট) তখন ফৌজদার বলা হতো। তিনি সিপাহসালারের লোক এবং তাঁর অধীনস্থ ছিলেন। সরকারে শান্তি ও বিধিব্যবস্থা বজায় রাখা ছিল ফৌজদারের দায়িত্ব । বিদ্রোহীদের পরাজিত করার পর যে-লুণ্ঠনসামগ্রী পাওয়া যেত, তার এক-পঞ্চমাংশ শাহী কোষাগারে পাঠাতে হতো।
বড় বড় শহরে কোতওয়াল মোতায়েন করা হতো, তাদের হাতে থাকত পুলিশ। তারা রাজস্বও আদায় করত। কোতওয়ালের হাতে নিজের এলাকার গুপ্তচর-বিভাগ থাকত। তার আরও কাজ ছিল— গৃহ ও মানুষজনের নাম রেজিস্টার-ভুক্ত করা, বিদ্রোহীদের গতিবিধির উপর নজর রাখা, জিনিসপত্রের মূল্য ও ওজন-পরিমাপ ঠিক রাখার দিকে লক্ষ্য রাখা, নিঃসন্তান অথবা উত্তরাধিকারীবিহীন মৃত পুরুষের সম্পত্তি অধিগ্রহণ করা, গরু-মোষ-ঘোড়া-উট হত্যার নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করতে না দেওয়া, ইচ্ছার বিরুদ্ধে সতী না হতে দেওয়া, বারো বছরের কম বয়সে খৎনা বন্ধ করা, নিষিদ্ধ দিবসে কোনো পশু হত্যা করতে না দেওয়া, ইত্যাদি ।
(৩) কেন্দ্রীয় অধিকারী—
শাসনব্যবস্থা সামরিক পদ্ধতিগত ছিল, সেজন্য অধিকারীদের মনসবও (পদবিন্যাস) ছিল তদনুরূপ। সামরিক ও অসামরিক মন্ত্রী-সচিবদের মধ্যেও খুব বেশি তফাত ছিল না। উদাহরণ-স্বরূপ, টোডরমল কখনো অর্থ-মন্ত্রী, কখনো ওয়াকিল্কুল (প্রধানমন্ত্রী) হয়ে কাজ করতেন। কখনো আবার তিনি সেনাধ্যক্ষ হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে নিজের পরাক্রম প্রদর্শন করতেন । প্রদেশাধিপতি (সিপাহসালার) কেবল নামেই নয়, বরং কাজেও সেনাধ্যক্ষ ছিলেন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর সংখ্যা ও কাজের স্পষ্ট হিসেব দেওয়া খুব কঠিন । তাঁদের কিছু কিছু ছিল-
১. ওয়াকিল— প্রধানমন্ত্রীকে বলা হতো ওয়াকিল, কখনো কখনো আরও স্পষ্ট করে বোঝাতে বলা হতো ওয়াকিলকুল (সর্বোচ্চ মন্ত্রী)। টোডরমলকেও ওয়াকিলকুল বলা হতো । আবুল ফজলকেও এই পদে সম্মানিত করা হয়েছিল এবং আরও অনেককেই।
২. ওয়াজির– আজকাল মন্ত্রীকে ওয়াজির এবং প্রধানমন্ত্রীকে ওয়াজিরে আজম বলা হয়, কিন্তু সেকালে অর্থমন্ত্রীকে ওয়াজির বলা হতো, যাঁকে প্রায়ই সম্বোধন করা হতো দীওয়ান বলে । দীওয়ান পদ যেমন সমগ্র রাজ্যে ছিল, তেমনি ছিল সুবাগুলিতেও। এই পার্থক্য বোঝাবার জন্য ব্যবহার করা হতো দীওয়ান-সুলতানাত্ এবং দীওয়ান-সুবা ।
৩. বখ্শী —
বখ্শী আসলে ভিক্ষুরই মঙ্গোল রূপ। আজও মঙ্গোলিয়ায় ভিক্ষুকে এই নামেই সম্বোধন করা হয়ে থাকে। চেঙ্গিসের রাজত্বকালে লেখালেখি ও পঠনের কাজকর্ম দেখতেন ভিক্ষুরাই। সেই সময় থেকেই বখ্শী পদের প্রচলন শুরু হয়। ভারতে এর মূল ইতিহাস অজ্ঞাত। হয়তো বাবরের সঙ্গেই এই পদ ভারতে এসেছিল।
বাবর ও তাঁর পূর্বপুরুষ তৈমূর চেঙ্গিসের রাষ্ট্রনৈতিক ব্যবস্থার অত্যন্ত পক্ষপাতী ছিলেন, সে-কথা তো আমরা জানি। আকবরের আমলে সামরিক অর্তমন্ত্রীকে বখ্শী বলা হতো। সুবাতেও বখ্শী থাকতেন এবং সাম্রাজ্যেও। এটি ছিল খুবই উচ্চপদ, মন্ত্রীদের সমকক্ষ। সলীমের পাল্লা ভারি করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন শেখ ফরিদ (মুর্তজা খান) নামক যে বখ্শী, তিনি ছিলেন সাম্রাজ্যের বখ্শী । সেনার জন্য বখ্শী রংরুট ভর্তি করতেন, তার রেজিস্টার রাখতেন ।
সমস্ত মনসবদারের নাম লেখা থাকত তাঁর কাছে। প্রাসাদের প্রহরীদের নামের তালিকাও থাকত তাঁর হাতে। বেতন দেওয়া, হিসেব রাখার দায়িত্ব ছিল তাঁর। তিনি সেনাপ্রধান ও সেনাদলের যথাযোগ্য স্থান নির্ধারণ করে দিতেন এবং প্রয়োজন হলে স্বয়ং সেনাপতি হিসেবে কাজ করতেন।
৪. সদর—
সমগ্র সাম্রাজ্যের ধর্মাধ্যক্ষকে সদর অথবা সস-সদর (সদরের সদর) বলা হতো । তিনি ধর্ম ও ধর্ম-বিষয়ক বিভাগের সর্বোচ্চ অধিকারী ছিলেন । ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে আকবর এই পদের গুরুত্ব নিশ্চিহ্ন করে দেন। সদর পূর্বে ইসলামের নামে সাম্রাজ্যের মধ্যে সাদাকে কালো, কালোকে সাদা, নিজের যা-খুশি তাই করে যেতেন ।
আরও দেখুনঃ